মঙ্গলবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৬

পুরুষ রচিত ধর্মের চোখে নারী –পর্বঃ০১ (হিন্দু ধর্ম)

নারী কখনো জননী, কখনো কন্যা অথবা স্ত্রী। এই সবই নারীর অবস্থান। এই অবস্থান বেধে নারী এক এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। জননী হিসাবে নারী সন্তান পালনে প্রধান ভুমিকা পালন করলেও ঐ সন্তানের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোন অধিকার জননীকে দেওয়া হয় না। পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক অবকাঠামোয় নারীকে নানা ভাবেই ছোট করে রাখা হয়েছে। আমাদের সমাজ-সংস্কৃতিতে জৈবিক নারীকে এমনভাবে শিক্ষা-দীক্ষা দেয়া হয়, জন্মের পর থেকেই, যাতে তাদের মধ্যে নারীত্ব বা নারীধর্ম প্রবলরূপে বিকাশ লাভ করে। নারী কি শুধুমাত্র ভোগপণ্য, সন্তান উৎপাদন ছাড়া তার কি কোন নিজস্ব সত্তা নেই?

এই বিশ্বব্রহ্মান্ডে প্রায় ৪২০০ ধর্ম এবং প্রায় ২৮৭০ টা গডের উৎপত্তি হয়েছে বিভিন্ন একেশ্বরবাদী এবং বহুঈশ্বরবাদীদের বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে(কোন এক *Ricky Gervais* দার্শনিকের মতে)।কিন্তু প্রতিটা ধর্মই নারীদের কম বেশী পুরুষতান্ত্রিক সমাজে করে রেখেছে পুরুষের ভোগ্যপণ্য কিংবা দাসী করে।আসুন এবার দেখা যাক,হিন্দু ধর্ম,খ্রীষ্টান ধর্ম,বৌদ্ধ ধর্ম,ইসলাম ধর্ম এবং ইহুদী ধর্মে নারীদের অবস্থান সম্পর্কে জেনে নিই।

এই নারী একেক সময়ে এক এক জায়গায় স্থান পায়। বিয়ের আগে বাবার বাড়ীর অধীনে কন্যার অবস্থান হয়। বিয়ের পর সেই কন্যা স্বামীর অধীনে চলে আসে। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলের সংসারে জায়গা পায় প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী। এই ভাবেই নারী একেক জায়গায় ঘুরতে থাকে। কিন্তু আদৌ তার কোন স্থায়ী ঠিকানা জুটে না তার কপালে।তাহলে নারী কি শুধুমাত্র ভোগপণ্য,নারী কি কেবল সন্তান উৎপাদনকারী আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্ত্রী নামের দাসী?

আসুন এবার তাহলে জানা যাক হিন্দু/সনাতন ধর্মে নারীর অবস্থান সম্পর্কে কি বলে- হিন্দু ধর্ম বড় ধরণের আঘাত হেনেছে নারী সমাজের প্রতি। "নারী নরকের দ্বার" কথার মধ্যেই হিন্দু ধর্মের মনোভাব পরিষ্কার ফুটে ওঠে। হিন্দু সমাজে নারী-পুরুষের ভূমিকা একেবারেই বিপরীতধর্মী। ধরে নেওয়া হয় নারী সংসারের ভেতরের কাজ সারবে আর পুরুষ করবে বাইরের কাজ। স্বভূমিতে দুজনকেই ক্ষমতাশীল মনে করা হলেও প্রকৃতক্ষেত্রে মেয়েদের স্থান হয় পুরুষের নিচে। তার পর বিবাহকে নারীর জীবনে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে হিন্দু ধর্ম নারী নির্যাতনকে প্রশ্রয় দিয়েছে বলা যায়। কারণ মনে রাখতে হবে হিন্দু ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের স্বীকৃতি নেই।

স্বামী মারা গেলে বিধবা নারীর বাঁচার অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই সতীদাহ প্রথা ভারতীয় সমাজে বহুদিন যাবত প্রচলন ছিল। রাজা রাম মোহন রায় বৃটিশ সাহায্যে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করে হিন্দু ধর্মের সংস্কার করেন। এখনো বিধবা হলেই সেই নারীকে সাদা কাপড় পরিয়ে নিরামিষ ভোজী রাখার প্রচলন রয়েছে। হিন্দু ধর্মে বিধবা বিয়ে চালু করেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আসুন এবারে দেখা যাক প্রাচীন ধর্মে নারীর স্থান কি রকম ছিল। হিন্দুধর্মের মূল গ্রন্থ চারটি বেদ। শুক্লযজুর্বেদের অন্তর্গত শতপথ ব্রাহ্মণে নারীকে তুলনা করে বলা হয়েছে যে - “সে ব্যক্তিই ভাগ্যবান, যার পশুসংখ্যা স্ত্রীর সংখ্যারচেয়ে বেশি” (২/৩/২/৮)। শতপথ ব্রাহ্মণের এই বক্তব্যের হয়তো অধুনা বিভিন্ন দরদী ধর্মবাদীরা ভিন্ন ব্যাখ্যা ভিন্ন যুক্তি দিতে চেষ্টা করবেন, কিন্তু পরবর্তী আরেকটি শ্লোকে আরও স্পষ্টভাবে হিন্দু ধর্মে নারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে সম্যক ধারনা করা যায় - “বজ্র বা লাঠি দিয়ে নারীকে দুর্বল করা উচিৎ, যাতে নিজের দেহ বা সম্পত্তির উপর কোনো অধিকার না থাকতে পারে” (৪/৪/২/১৩) ।

অপরপক্ষে যে নারীরা বেদ-উপনিষদের শ্লোক-মন্ত্র রচনা করেছেন, সেই নারীদেরই উত্তরসূরীদের জন্য মনু বেদসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ পাঠের অধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। “নারীরা ধর্মাজ্ঞ নয়, এরা মন্ত্রহীন এবং মিথ্যার ন্যায় অশুভ” (মনুসংহিতা, ৯/১৮)।

সনাতন ধর্মের মণিষী মনু বলেছেন ‘নারী শৈশবে পিতার, যৌবনে স্বামীর এবং বার্ধ্যকে পুত্রের অধিন থাকবে’। এই উক্তি নারীর চিরকালের বন্দিত্বের কথাকেই স্মরণ করে দেয়। নারীর আজকের যে বন্দি দশা তা মানুষের সামগ্রীক মনুষত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। শাস্ত্রীয় প্রবঞ্চনার প্রধান শিকার নারী।
স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে বা কোন ধর্মানুষ্ঠানে শূদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেয়া হয়নি, নারীকেও তেমনি স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাতে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে-

‘নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।’
স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ (৯/১৮) ।

# নারীদের সাথে কোনো স্থায়ী বন্ধুত্ব হতে পারে না। নারীদের হৃদয় হচ্ছে হায়েনাদের হৃদয়। (ঋগবেদ ১০:৯৫:১৫)

# নারীরা কোনো নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা নাই বললেই চলে। (ঋগবেদ ৮:৩৩:১৭)

# নারীরা শক্তিহীন বা কর্তৃত্বহীন। তারা পৈত্রিক সম্পত্তির কোনো অংশ পাবে না। (যজুর্বেদ ৬:৫:৮:২)

# নারীরা দৃষ্টিকে নত করে চলবে, সামনের দিকে তাকাবে না। (ঋগবেদ ৮:৩৩:১৯)

# বিধবা নারীরা পুনরায় বিয়ে করতে পারবে না। তাদেরকে বরং নিরামিষভোজী ও অত্যন্ত দ্বীনহীনভাবে বাকি জীবন কাটাতে হবে। (মনুসংহিতা ৫)

# নারীদেরকে অবশ্যই দিন-রাত নিজ পরিবারের পুরুষদের অধীনে থাকতে হবে। তারা যদি কোনো রকম ইন্দ্রিয়াসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তাদেরকে অবশ্যই কারো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। (মনুসংহিতা ৯:২)

# শৈশবকালে একজন নারী তার পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনে তার স্বামীর অধীনে থাকবে, স্বামী/লর্ড মারা গেলে তার পুত্রদের অধীনে থাকবে। নারীরা কখনোই স্বাধীন হতে পারবে না। এমনকি তারা স্বাধীন হওয়ার যোগ্যই না। (মনুসংহিতা ৫:১৪৮, ৯:৩)

# একজন স্বামী যতই খারাপ হোক না কেন, তথাপি একজন কর্তব্যনিষ্ঠ স্ত্রী সেই স্বামীকে দেবতা হিসেবে ক্রমাগত পূজা করবে। (মনুসংহিতা ৫:১৫৪)

# একজন নারীর স্বামী মারা যাওয়ার পর সেই নারী কখনোই অন্য কোনো পুরুষের নাম মুখে নিতে পারবে না। (মনুসংহিতা ৫:১৫৭)

# স্বামীর প্রতি দায়িত্ব লঙ্ঘনের দ্বারা একজন স্ত্রী এই পৃথিবীতে অসম্মানিত হবে, মৃত্যুর পর তার এই পাপের শাস্তিস্বরূপ একটি শৃগালের গর্ভে বিভিন্ন রোগ দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকবে। (মনুসংহিতা ৫:১৬৪)

# নারীদের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ সৎকারের সময় পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে কিছু পাঠ করা যাবে না। (মনুসংহিতা ২:৬৬)

# পুরুষের উচিত নয় তার মা, বোন, অথবা কন্যার সাথে একাকী বসা, পাছে কী হতে কী হয়। (মনুসংহিতা ২:২১৫)

# নারীরা পুরুষের সৌন্দর্য বা বয়স কোনোটাই বিচার না করে সুদর্শন বা কুৎসিত যা-ই হোক না কেন, পুরুষ হলেই তার প্রতি নিজেকে সঁপে দেয়। (মনুসংহিতা ৯:১৪)

# নারী ও শূদ্ররা বেদ পড়া বা শোনার উপযুক্ত নয়। (সূত্র)

# নদী যেমন সমুদ্রের সাথে মিশে লবনাক্ত সমুদ্রের গুণপ্রাপ্ত হয়, তেমনই নারী বিয়ের পর স্বামীর গুণযুক্ত হন । (মনুসংহিতা ৯:২২)

#স্ত্রীলোকদের বিবাহবিধি বৈদিক সংস্কার বলে কথিত, পতিসেবা গুরুগৃহে বাস এবং গৃহকর্ম তাদের হোমরূপ অগ্নিপরিচর্যা। (মনুসংহিতা ২:৬৭)

#আবার গৃহকর্ম এবং সন্তান উৎপাদন সম্পর্কে বলা হয়েছে - সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্যই নারী এবং সন্তান উৎপাদনার্থে পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে। (মনুসংহিতা ৯:৯৬)

# প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, বিবাহিত নারীরা ডিভোর্স দিতেও পারবে না আবার নিতেও পারবে না। একবার কারো সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আমৃত্য পর্যন্ত তার সাথেই থাকতে হবে । (সূত্র নিষ্প্রয়োজন)
(পর্ব আকারে লেখা হচ্ছে, চলতে থাকবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন