বুধবার, ২ নভেম্বর, ২০১৬

হিন্দু বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ আইন সমাচার !!!

নারী ও পুরুষ এর একত্রে বসবাস করার সামাজিক,ধর্মীয় এবং আইনগত স্বীকৃতকেই বিবাহ বলে।

ভালোবাসাই একজন নারী ও একজন পুরুষের মাঝে হূদয়ের অটুট বন্ধন তৈরি করে দেয়। তৈরি করে সাংসারিক বন্ধন।একজন সুন্দর মনের ও সুন্দর গুণের স্ত্রী সংসারকে তাঁর নিজের আলোয় আলোকিত করে তুলতে পারেন। সাজিয়ে তুলতে পারেন সংসার জীবনকে সুখের স্বর্গীয় বাগানের মতো করে।

টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে ‘সম্পর্ক’ বিশেষজ্ঞ টি তাশিরো বলেছেন,” টাকা-পয়সা, সৌন্দর্য বিবাহিত জীবনকে সুখী করতে পারে না। অন্তত একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। তাঁর মতে, একটি ভালোবাসাময় সুখী বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সবার মধ্যে যে গুণটি থাকা প্রয়োজন, তা হলো—আন্তরিকতা। আন্তরিক বলতে তিনি এমন কাউকে বুঝিয়েছেন, যিনি হবেন বিনীত, নমনীয়, বিশ্বাসযোগ্য, ভালো স্বভাব, সহযোগী মনোভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, উদার ও ধৈর্যশীল।“

যেহেতু, দুজন নর-নারীর পারস্পারিক সম্মতি এবং পারিবারিক কিংবা সামাজিক ভাবেই বিবাহ সম্পন্ন হয় সেহেতু তাদের সাংসারিক জীবন সুখের হবার কথাই।কিন্তু অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়ে সাংসারিক জীবনে নেমে আসে দাম্পত্যকলহ।দাম্পত্যকলহ অনেক কারণেই হতে পারে।যেমন- ভালবাসার অভাব, বিশ্বাস ও বিশ্বস্ততার অভাব, যৌনাচার,বহুগামিতা, দৈহিক যৌন সম্পর্কে অক্ষমতা, পুরুষত্বহীনতা, সমকামিতা, যৌনবিকৃতি, পাশবিকতা, যৌন মিলনের অনিহা এবং এড়িয়ে চলা, সন্তান দানে অক্ষমতা, দায়িত্বজ্ঞানহীন ভবঘুরে, ভুল সঙ্গী নির্বাচন ইত্যাদি ইত্যাদি।আবার, বাইরের কোন শক্তি বা তৃতীয় কোন শক্তিও দাম্পত্য সমস্যার কারণ হয়ে আসে।এর মধ্যে পিতা, মাতা, ভাই বোন, শশুর শাশুড়ি, দেবর ননদ, কোন মিথ্যা গুজব, অন্যের পক্ষপাতিত্য মনোভাব, অন্যের অতিরিক্ত আবেগ সোহাগ ইত্যাদি।

আর এসকল কলহের কারণেই নেমে আসে দাম্পত্য জীবনের বিচ্ছেদ।তখন দুইজনের সম্মতিক্রমে একে অপরের সাথে সম্পর্কের ইতি টানতে চায় অথবা একজনের ইচ্ছাতেই আইনগত ভাবে উপযুক্ত কারণ দর্শীয়ে এবং তা আইনের চোখে প্রমান করেও বিবাহ সম্পর্কে ইতি টেনে দেয়।তবে বিবাহ বিচ্ছেদ করা যত সহজ মনে হয় আসলে ততোটা সহজ না।কেও ইচ্ছা করলেই একটা সম্পর্কে ইতি টানা যায় না।আর যদি সেটা রক্ষনশীল সমাজ এবং ধর্মের হয় তাহলে আরো বেশী ঝামেলা পোহাতে হয় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে।

হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ‘পারিবারিক আইন বহু পুরানো’। সাড়ে তিন হাজার বছরের অধিক সময় ধরে গড়ে উঠেছে শাস্ত্রীয় ভিত্তিক হিন্দু আইন। প্রথার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এই আইন। দত্তক, বিয়ে, উত্তরাধিকার, দান-উইল, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি প্রশ্নে বাংলাদেশের আদালতে হিন্দু শাস্ত্রীয় আইন অর্থাৎ বিধিনীতির উপর নির্ভর করে বিচার করতে হয়। ইহার সাথে বিভিন্ন সময়ে প্রনীত সংসদীয় আইন রয়েছে। হিন্দু আইন ধর্মীয় আইন, প্রথাগুলো ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। এই প্রথা নিয়েই হিন্দু আইন, ধর্মীয় অনুশাসনের উপর চালচলন, প্রথা গড়ে উঠেছে। আর সেই অর্থেই হিন্দু আইন শাস্ত্রীয় আইন। হিন্দু আইনে বিবাহ কেবল প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তি নয়, এই বিবাহ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একঅলংঘনীয় বন্ধন।

বাংলাদেশে দু’ধরনের বিয়ে প্রচলিত, দানে বিয়ে এবং পনে বিয়ে। উচ্চ বর্ণে কন্যার পিতা কন্যাকে দান করেছেন।আর বর ব্রাহ্মণের বলে দেওয়া মন্ত্র পাঠ করে কন্যাকে বিয়ের মাধ্যমে ঘরে তুলে নিতে চায়।পনে বিয়ে নিম্ন বর্ণের মধ্যে বেশী প্রচলিত।এ বিয়ে মূলত মালা বর কনের মালা বদল এবং হাতে শাখা এবং সিথিতে সিঁদুর পরিয়ে এবং উপস্থিত লোকদের সাক্ষী মেনেই বিবাহ কাজ সম্পন্ন করা হয়।বিবাহ বিচ্ছেদ- উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের মধ্যে শাস্ত্রীয় বিধানে বিয়ে বিচ্ছেদে কোন আইন নেই। নিম্ন বর্নের মধ্যে প্রথাগত কয়েকটি ক্ষেত্রে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রচলন আছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে নাই।
বাংলাদেশে হিন্দু বিবাহ বিচ্ছেদ খুবই জটিল। তবে যেটা সহজ তা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী আলাদা বসবাস করা। বিবাহ বিচ্ছেদের মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও যখন বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব না তখন স্ত্রী স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে নিজ পিত্রালয়ে বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে পৃথক বসবাস করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হন। ১৯৪৬ সালে বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান এবং ভরণপোষণ আইন পাস হওয়ার পর, এ আইন অনুযায়ী- এক স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেতে পৃথক থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবেন।

আমাদের দেশ স্বাধীন হওয়ার দীর্ঘ প্রায় ৪৫ বছর সময় পেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশে হিন্দু পারিবারিক আইনের উল্লেখযোগ্য কোন আইন প্রনীত হয়নি।তবে বর্তমান সরকার হিন্দু আইনের ব্যাপক সংস্কার করেছে যেমন-সম্পত্তি বন্টন, হিন্দু বিবাহ রেজিষ্ট্রেশন আইন, ইত্যাদি এবং বাংলাদেশ ‘ল’ কমিশনের মাধ্যমে হিন্দু আইন সংস্কারের ও সংশোধনের কাজ এগুচ্ছে।

আমাদের বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ সম্পর্কীত যে মামলাগুলো আদালতে যায় তা মূলত নিম্ন বর্ণ থেকেই যায়।পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ অনুসারে এখতিয়ার ক্ষমতা রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়েরও আদালতে যাবার। বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব, ভরণপোষণ, দাম্পত্য জীবন পুরুদ্ধার বিষয়, এই পাঁচটি বিষয়ে পারিবারিক আদালতের বিচারের ক্ষমতা রয়েছে।

বাংলাদেশের সনাতন হিন্দু আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ ও পুনঃবিয়ের স্বীকৃতি নেই। হিন্দু বিয়েতে কোনো চুক্তিনামা না থাকায় অনেক নারী নির্যাতন সহ্য করেও সংসার করেন। পারিবারিক আইনজীবী মাহবুবুল ইসলাম মজুমদার বললেন, ‘১৯৮৫ সালের পারিবারিক আইনের ৫ ধারায় বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, মোহরানা, ভরণ-পোষণ, সন্তান-সন্ততিগণের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান এই ৫টি অধিকার দেয়া হয়েছে কিন্তু সেখানে বাদীর নিজ ধর্মের আইন অনুযায়ি প্রতিকার পাবেন।’

২০১২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শাস্ত্রীয় বিবাহের দালিলিক প্রমাণ সুরক্ষার লক্ষ্যে ‘হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন ২০১২’ প্রণীত হয়। অবশ্য এই আইন অনুযায়ী হিন্দুদের বাধ্যতামূলকভাবে বিবাহ নিবন্ধন করতে হবে না, কিন্তু কেউ চাইলে প্রথাগত পদ্ধতিতে বিয়ের পাশাপাশি বিবাহ নিবন্ধনও করতে পারবেন। তাই প্রেমের বিয়েতে কেউ কেউ রেজিস্ট্রেশন করলেও বেশিরভাগ স্যাটেল ম্যারেজের বেলায় প্রথাগত পদ্ধতিতেই হচ্ছে।

বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে বলা হয়েছে,

Ø স্বামী অথবা স্ত্রী একজন অন্যজনের উপর শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন নির্যাতন করলে।

Ø যে কোন একজন যদি হিন্দু ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে।

Ø কোন একজন যদি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকেন এবং চিকিৎসা করানোর পরও যদি সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে।

Ø কোন একজন যদি সংক্রামক কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হইয়া থাকেন যা চিকিৎসা দ্বারা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ অথবা ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নাই বলিয়া চিকিৎসক সনদ প্রদান করেন।

Ø স্বামী স্ত্রীকে যদি একাধিক্রমে দুই বছর ধরে ভরণপোষণ প্রদান না করিয়া থাকেন।

Ø স্বামী যদি স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় বিবাহ করিয়া থাকেন।

Ø স্বামী অথবা স্ত্রী যদি দুই বছর ধরে নিরুদ্দেশ থাকেন।

Ø স্বামী অথবা স্ত্রী যে কোন একজন কোন অপরাধে জড়িত থাকার কারণে সাত বছরব বা তার দণ্ডপ্রাপ্ত হইলে।

Ø স্বামী অথবা স্ত্রী যদি একজন অন্যজনকে অপরাধমূলক কাজ করিতে বাধ্য করিয়া থাকেন।

Ø স্বামী বিবাহের সময় পুরুষত্বহীন থাকিলে এবং তাহা আবেদন দাখিল করা পর্যন্ত বহাল থাকিলে আদালতে আবেদন করলে উভয়পক্ষের মতামতের ওপর ভিত্তি করিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের ডিক্রি প্রদান করিবেন। এক্ষেত্রে শর্ত থাকে, স্ত্রী গর্ভবতী থাকিলে সন্তান ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর হইবে না।

Ø বহু বিবাহের ক্ষেত্রে খসড়া আইনে বলা হয়েছে, একজন হিন্দু নারী ও একজন হিন্দু পুরুষের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যদি কোন হিন্দু পুরুষ এক বা একাধিকবার অন্য কোন নারীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করিয়া থাকেন তাহা হইলে সেই ব্যক্তি সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন অথবা দুই বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হইবেন। এবং দণ্ডিত হইবার পর দণ্ডিত পুরুষের স্ত্রীর বিবাহে কোন বাধা থাকিবে না।

উপরিউক্ত শর্তসাপেক্ষে এবং উপযুক্ত কারণ দর্শিয়ে এবং দম্পত্যির উভয়ের সম্মতিক্রমেই কেবল মাত্র আইনের আওতায় বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারবে।

বি.দ্রঃ ঠেকছিলাম যেখানে শিখছিও সেখানে।
©      সূত্রঃ ল অফ ওমেন,কালের কন্ঠ,দেশ বিদেশ,প্রথম আলো