শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ কি আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র !!



সেক্যুলারিজম মানে ধর্ম নিরপেক্ষতা।সেক্যুলার শব্দের অর্থ হচ্ছে ইহলৌকিক, ইহজাগতিক, পার্থিব, পরকালবিমুখ, আখিরাত বিমুখ ইত্যাদি।পারিভাষিক অর্থে সেক্যুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে এমন একটি মতবাদ, চিন্তাধারা ও বিশ্বাস, যা পারলৌকিক ধ্যান ধারণা ও ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনভাবে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হলো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। বাংলাভাষায় Secularism-এর অনুবাদ করা হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা। এর দ্বার বুঝানো হয়েছে যে, যার ধর্ম তার কাছে, পরধর্ম সহিষ্ঞুতা এর উদ্দেশ্য।

সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ –‘সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা’ নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিৎ।আমি জানি না একজন মানুষের কি ভাবে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা সম্ভব, ধর্মগুলো তো অনেক সময়েই বিপরীতমুখী কথা বলে।

ইউরোপের রেনেসাই হলো ইহজাগতিকতার বিকাশ। এর ফলে জ্ঞান বিজ্ঞান যুক্তি তর্কের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ধর্মীয় পীড়নের বিরুদ্ধে একটা জাগতিক মানবতাবাদী জনগোষ্ঠির প্রতিবাদ শুরু হলো। স্ত্রী পুরুষের যৌন মিলন ছাড়াই মেরীর পেটে যিশুর জন্ম হয়। আর সেই যীশুর হাতেই নানান মীরাকেল ঘটনা ঘটে। এই সবই একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের কাছে মিথ ছাড়া আর কিছু নয়। ইউরোপের মানুষের ধারনায় ও ক্রিয়াকলাপে সেক্যুলারিজম নিশ্চিত ভাবে রূপ পেতে থাকে রেনেসার সময় থেকে। আর তখন থেকে ইউরোপে আধুনিকতার সুত্রপাত হয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে কিছু মানুষ, মানুষ হিসাবে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। এটা মানুষের মানবমুখী মনোভবের যাত্রা। এটাই ইহজাগতিকতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত মানব জীবন। প্রকৃত পক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, রীতি নীতি, মন্ত্র- তন্ত্র ইত্যাদির দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মানুষের চিন্তা ও কর্মকে মুক্তি দিয়ে জাগতিক সকল বিষয়ে তাকে উতসাহিত করাই সেক্যুলারিজম।

আসুন ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে কি বুঝায় তা দেখা যাক। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আমরা বুঝি ধর্ম কর্মের স্বাধীনতা। সকল ধর্মে সমান অধিকার। অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা বা অধর্মতা বুঝায় না। যে যার ধর্ম পালন করবে কিন্তু কারও ধর্মে কেউ হস্তক্ষেপ করবেনা। রাষ্ট্রের সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হবে। এটাই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা।



আর এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খুব বেশী প্রযোজ্য। কারণ রাষ্ট্রের এই মূল নীতিই ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে মানুষকে মানবিক ও ইহোজাগতিক নাগরিকে পরিনত করে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্ম হীনতা না হলেও এর চরিত্র অন্য রকম যা আজ ধর্মাশ্রয়ী মানুষের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আমরা কি বুঝি? ধর্মীয় নানা বিধি নিষেধ যদি ব্যক্তির ইহোজাগতিক কাজ কামে বাধার সৃষ্টি করে তাহলে ব্যক্তি যদি নিজের সুখ সাচ্ছন্দের জন্য ঐ সব বিধি নিষিধ উপেক্ষা করে নিজস্ব স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটায় সেই ক্ষেত্রে তাকে সেক্যুলার ধরা হবে। তবে একজন ধার্মিক মানুষ কতটা সেক্যুলার হতে পারে? এক ধর্মে যেটা হারাম করা হয়েছে অন্য ধর্মে সেটা হালাল করা হয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া হারাম আর ইসলাম ধর্মে সেই গরুর মাংস খাওয়াকে হালাল করা হয়েছে। তেমনি এক ধর্মে মূর্তি পুজাকে শিরক আর অন্য ধর্মে সেই মুর্তি পুজাকে ধর্মের অন্যতম অংশ বলে ধরা হয়। এই অবস্থায় দুই ধার্মিকের সহাবস্থান কি ভাবে সম্ভব হবে? এ রকম তীব্র বিপরীত অবস্থায় ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রই নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করবে আইনের মাধ্যমে। আর এই আইন কোন ধর্মাশ্রয়ী আইন নয়। এই অবস্থা রাষ্ট্রীয় আইন মেনে নিয়েই প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্ম পালন করতে পারবে। এর মধ্যে যদি এক ধর্মের কাজ কর্মের কারণে অন্যের ধর্মানুভুতিতে আঘাত আসে সেই ক্ষেত্রে কি হবে? সেই ক্ষেত্রে একমাত্র ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রই নাগরিককে বিচারের কাঠ গোড়ায় দাড় করাবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ড দিবে যেটা সৌদি আরব করে যাচ্ছে। আর ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র সেই ক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে।




সব ধর্মের সহাবস্থানই ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ সম্পুর্ণ হয় না। ইহজাগতিক ভাবনার ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রয়োজন অপরিসীম। আর এই ধর্মের থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সম্পুর্ণ হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা আধুনিক রাষ্ট্রের মূলনীতি বলেই স্বীকৃত হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অসত্য। ধর্মের সাথে যে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাই বোঝায় রাষ্ট্রীয় উদযোগের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগহীনতা, পরলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন তবে ইহোজাগতিকতাই রাষ্ট্রের প্রধান ধর্ম। ধর্ম থাকতে পারে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে। রাষ্ট্র সকলকে নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেবে সেই সাথে ধর্মহীন বা নাস্তিকের অধিকারও নিশ্চিত করবে সমান ভাবে। তবে রাষ্ট্রের সাথে কোন ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না। একজন নাস্তিক ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে তার মত প্রকাশ করার অধিকার রাখে আর সেই অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের।

তাহলে কি আমি বলতে চাচ্ছি, রাষ্ট্র ধর্মের বিরোধীতা করবে? একেই কি আমরা ধর্মনিরপেক্ষ বলবো? অবশ্যই না । সমর্থন যেমন একটি পক্ষ, বিরোধীতা ও তেমনি একটি।রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার অর্থ হবে নির্মোহতা,নির্লিপ্ততা । সকল ধর্মের প্রতি সমান কিংবা কোন ধর্মের প্রতি বিশেষ-কোন মডেলেই ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র নামের সংগঠনটির কোন মোহ থাকবেনা, তার কার্যক্রম কিংবা নীতিমালা নির্ধারনে ধর্মের কোন ভূমিকা থাকবেনা । রাষ্ট্র তার নীতিনির্ধারন করবে নাগরিকের বস্তুগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য । এই নীতিমালা যদি ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হতে পারে, নাও হতে পারে ।নাগরিক তার খেয়ালখুশী মতো ধর্মপালন করবে, যেমন নাগরিক তার পছন্দমতো খেলাধুলা করে,কাব্য-সংস্কৃতির চর্চা করে অথবা করেনা । রাষ্ট্র এইসবে নাক গলাতে যাবেনা যতোক্ষন না তা রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে সংঘাতপূর্ন হয়ে উঠে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটির মধ্যে সুক্ষ চালবাজি আছে ।আমাদের সংবিধানের শুরুর কথাটি যদি ধরি, বলা হয়েছে জাতি,ধর্ম,বর্ণ,শ্রেনী,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার।যদি ও পরবর্তীতে অবৈধ সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে সংবিধানের ধারাগুলোকে পরস্পর বিরোধী বানিয়ে ফেলা হয়েছে । সকল ধর্মের অধিকার সমান হলে শুধু ‘‘বিসমিল্লাহির রাহামানির রহিম’’ কি করে যুক্ত হয়?ধর্মকে আশ্রয় করে বাংলাদেশে ব্যাংক বীমা, হাসপাতাল, মসজিদ,মাদ্রাসা,মন্দির,গীর্জা,প্যাগোডা ইত্যাদি গড়ে উঠছে। যেমন বাইতুল মোকাররাম একটা সরকারী কেন্দ্রীয় মসজিদ,ঢাকেশ্বরী মন্দির আরো কত কত।আপনি মসজিদের উন্নয়ন করে,মন্দিরের সংস্কার করে পূন্যবান হবেন, বেহেশত কিংবা স্বর্গে যাবেন যান-কিন্তু তার জন্য আমার করের টাকা ব্যয় হবে কেনো?আমি রাষ্ট্রকে কর দিচ্ছি আমার এবং সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার জন্য।বাংলাদেশ ইসলামিক ফাইন্ডেশন আর একটি সরকারী সংস্থা। এই ভাবে ধার্মিক রাষ্ট্রের সহযোগীতায় অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে যা ধর্ম নিরপেক্ষতার বিপরীত পন্থী ।এইসব প্রশ্ন উত্থাপিত না হলে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি শুনতে বেশ ভালো লাগে।বেশ একটা ধর্মনিরপেক্ষতার আমেজ ছড়ায়,সকল ধর্মের অধিকার সমান-বাহ ।কিন্তু এই কিসিমের ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে রাষ্ট্র ধরেই নিচ্ছে প্রতিটি মানুষ মাত্রই কোন না কোন ধর্মের অন্তর্গত । ধর্মের বাইরে মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই!

ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয় এই দোহাই দিয়েই বাংলাদেশকে আস্তে আস্তে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিনত করা হয়েছে।আমিও তাই বলি, ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়।কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ মানে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সংশ্লিষ্ট থাকবে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল মন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষতা হওয়া উচিত। যেমনটি আমাদের রাষ্ট্রের ”৭২” এর সংবিধানে অন্তভর্’ক্ত ছিল।কিন্তু সেটা কেবল মাত্র সংবিধানেই আবদ্ধ ছিল বাস্তবে না।তার প্রমান,

“বাংলাদেশ হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করবে। খ্রীস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।“

এ বক্তৃতা থেকে বঙ্গবন্ধুর সর্বধর্মের প্রতি সদয়ের সুর ধ্বনিত হলেও সেক্যুলারিজমের মুল ধারাটি ঠিক অনুধাবিত হয় নি।কারণ ধর্ম বিশ্বাস রাষ্ট্রের জনগণের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়।১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষনা পত্রে আদেশ বলে সংবিধানের প্রস্তবনার পূর্বে ‘‘বিসমিল্লাহির রাহামানির রহিম’’ যুক্ত হলে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় এলো সর্ব শক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’’ এরই ধারাবাহিকতার পথ ধরে ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষনা করেন। রাষ্ট্র একটা ইহোজাগতিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কোন পারলৌকিক গত কোন ধর্ম থাকতে পারে না।




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন