শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬

সংখ্যালঘু শব্দ মানেই নির্যাতনের শিকার (২০১৬) !!!

সংখ্যালঘু শব্দ মানেই নির্যাতনের শিকার। মুল অপরাধীদের আড়াল করে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয় যে কোন দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীরাই। আর শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা।

সাম্প্রদায়িকতা শব্দটির আক্ষরিক অর্থ সম্প্রদায়গত চিন্তা। সেই সম্প্রদায় হতে পারে ভাষাভিত্তিক, ভূখ-ভিত্তিক, গোত্র ও বর্ণভিত্তিক কিংবা আদিবাসীভিত্তিক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এ উপমহাদেশে সব কিছু ছাপিয়ে ধর্ম পরিচয়ই সম্প্রদায়ের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ধর্মের ভিত্তিতে সাতচল্লিশে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশ হয়েছে। আবার একাত্তরে এ দেশের মানুষ সেই পাকিস্তানকে নাকচ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যার প্রথম সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে প্রতি বছরই উৎসব মূখর ভাবে নির্যাতন চালানো হয় সংখ্যালঘুদের উপর। কখনও জমি দখল, কখনও ধর্ষণের পরে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, কখনও কখনও মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর, কিংবা চাঁদা আদায়ের মতো ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়, কখনও ভিটেমাটি ছাড়া এমনকি দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত এর মতে, ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের পর প্রতিদিন গড়ে ৬৩২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশ ছাড়ছেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম আদমশুমারিতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ, যা এখন কমে হয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। গবেষকেরা বলছেন, এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ৩০ বছর পর বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাউকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর মোটা দাগে হামলার উদযাপন হয় ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ভারতের বাবরী মসজিদের উপর হামলার গুজব ছড়িয়ে দিয়ে।মানে বলতে পারেন,কুপ পরে ভারতের সংখ্যালঘুর উপর আর লাশ পড়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের। তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলিত হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো বাংলাদেশী সংখ্যালঘু নির্যাতনের।কিন্তু সেই আবার পুরুনো বাবরী মসজিদের গুজব কাটতে না কাটতেই যখন সত্যি সত্যি বাবরী মসজিদের ঘাড়ে কুপ পড়ে ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের লাশ পরলো ঠিক তখনই তার জের ধরে বাংলাদেশী বৌদ্ধ এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের লাশের সাথে সাথে সৎকারও সম্পন্ন করা হলো।কিন্তু এই সহিংসতা চলাকালে রাজনৈতিক দল আওয়ামী-লীগ প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল।১৯৯০ সাল এবং ১৯৯২ সালের ঘটনা রাজনৈতিক দলের চরিত্র একটু খেয়াল করে মনে রাখবেন।

এর পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন,মন্দির,হিন্দু বাড়িঘর,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস শুধু আনুপাতিক হারে অতিক্রমই করেছে।তবে হিন্দু নারী ধর্ষণের অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল ২০০১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি ও ইসলামি দল জামাত ক্ষমতায় আসার পরপরই।তার একমাত্র কারণ হলো বাংলাদেশী হিন্দুরা আওয়ামী-লীগের একনিষ্ঠ ভোট ব্যাংক।

এরপর আরেকটি বড়ধরনের হিন্দু নির্যাতন শুরু হয় ২০১৩ সালে। মুক্তিযুদ্ধের মানবাতা বিরোধী অপরাধে মিরপুরের কসাই খ্যাত কাদের মোল্লার প্রত্যাশিত ফাঁসির রায় না পেয়ে বাংলাদেশের লক্ষ তরুন যখন জমায়েত রাজধানী ঢাকার শাহবাগে।ঠিক তখনই ইসলামি দল জামাত এবং প্রধান বিরধী দল বিএনপি মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিতে আর ক্ষমতার সিঁড়ি হিসেবে আবারও বেছে নেয় সংখ্যালঘুদের উপর হামলা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি জানোয়ার বাহিনী সদস্যরা এবংরাজাকার বাহিনী জাতিগত নির্মূলীকরণ এর খেলায় নেমেছিল ঠিক তেমনি করে ১৯৭১ সালের মানবতা বিরোধী অপরাধের শাস্তি বিঘ্নিত করার জন্য সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, হত্যা, মন্দির-প্রতিমা ভাঙচুর সবই।যা ছিলো ১৯৭১ সালের অনুকরণেই সংখ্যালঘু হিন্দু নিধন।

                                      

এরপর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের পর আবার শুরু হয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতন যেখানে কিছু জায়গাতে শাসকদল আওয়ামীলীগের লোকজনও যে জড়িত ছিল তার স্পষ্ট প্রমান রয়েছে।আর এখান থেকেই শুরু হলো আওয়ামী-লীগের সংখ্যালঘু নির্যাতন,হামলা,উচ্ছেদ,ভূমিদখল থেকে সব ধরণের উগ্রতা।

অথচ সংখ্যা লঘু সম্প্রদায়কে সব সময় বুঝানো হয় বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় এলে অবস্থা আরও খারাপ হবে। আর আওয়ামিলীগই একমাত্র দল যারা তাদের সুরক্ষা দিতে পারে। এই তথা কথিত সুরক্ষার আশায়ই স্বাধীনতার পর থেকেই সংখ্য লঘু সম্প্রদায় আওয়ামিলীগের ভোট ব্যাংক হিসাবে ব্যাবহার হয়ে আসছে। প্রকৃত পক্ষে হিন্দু সম্পত্তি দখল আর লুটপাটে আওয়ামিলীগ নেতা-কর্মীরাই এখন অগ্রগামী।

এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নতুন কোন ব্যপার না।আর এই ঘৃণ্য বিষয় নিয়ে সরকারের উদাসিনতাও নতুন না।তবে, বিএনপ-জামাতের আমলে সংখ্যালঘু নির্যাতন ছিল স্বাভাবিক ঘটনার মত হিন্দু কিংবা সংখ্যালঘুদের।তাদের ধারণাই ছিলো আওয়ামী-লীগ ব্যতীত যেকোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসা মানেই তাদের উপর কারণে অকারণে নির্যাতন হতে পারে এবং তাদের দেশ ত্যাগ করে পাশের দেশ ভারতে আশ্রিত হতে হবে। সংখ্যালঘুরা যাদের চোখে একটু হলেও ভরসা দেখতে পেত সেই বহুল পরিচিত অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিকদল আওয়ামী-লীগ সরকার কি করছে তা একটু চোখ বুলিয়ে দেখা উচিত শুধুমাত্র ২০১৬ সালের কর্মকাণ্ড! যার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক এমপি-মন্ত্রী-নেতারাই জড়িত প্রায় সকল ক্ষেত্রে।

চলতি বছর জুড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্বিচারে হামলার খবর বারবার এসেছে গণমাধ্যমে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে ছিল; পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে যজ্ঞেশ্বর রায় হত্যা, সাতক্ষীরার আশাশুনিতে ১০০ হিন্দু পরিবারকে গ্রামছাড়া করা, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় ৭০ বছরের সাধু পরমানন্দ খুন, কক্সবাজারে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দির ভাঙচুর, ঝিনাইদহে হিন্দু পুরোহিত হত্যা, পাবনায় আশ্রমের সেবায়েৎকে হত্যা, মাদারিপুরে কলেজশিক্ষককে হত্যা চেষ্টা, যশোরে সেবায়েতের লাশ উদ্ধার, গাজীপুরে পুরোহিতকে খুনের চেষ্টা, বগুড়ায় পুরোহিত হত্যা, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ ও রংপুরে হত্যার হুমকি ও ঢাকায় রামকৃষ্ণ মিশনে ধর্মপ্রচারে বাধা দেওয়ার ঘটনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে উদ্দেশ্য মূলক ভাবে কাবার শরীফের উপর শিবের মূর্তির ফটোশপ করে হিন্দু পাড়াতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ।

“২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে -৯৮ জন সংখ্যালঘু হত্যা করা হয়েছে , ১০০৯ জনকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে, ১৮ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, ২৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ২২জন নিখোঁজ রয়েছেন , ২০৯টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে, ৩৬৬টি মন্দিরে পূজা বন্ধ করা হয়েছে , ৩৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে, ৩৫৭ জনকে জখম করা হয়েছে, ৯৯জনকে চাঁদাবাজি-মারধর ও আটকে রেখে নির্যাতন, ১৬৫টি লুটপাটের ঘটনা , ১৩টি বসতঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে, ৮৬টি সম্পত্তি দখলের ঘটনা ঘটেছে, ৬১টি ভূমি দখল, ২১০টি উচ্ছেদে ঘটনা ঘটেছে, ৩২৬টি উচ্ছেদের তৎপরতার ঘটনা ঘটেছে, ৩৪৩১টি উচ্ছেদের হুমকি, ৭১১টি দেশ ত্যাগের হুমকি, ১৪১টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, চুরি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, ২,৩২৮ বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, চুরি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে , জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত বা ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা এক হাজার ২৫১টি। সব মিলিয়ে চলতি বছর ১৫ হাজার ৫৪টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সূত্র

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ কোনো একসময় মনে করা হতো আওয়ামী লীগ সরকার আসা মানেই সংখ্যালঘুদের একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা। কিন্তু আজকাল যে সরকারই আসুক না কেন, সংখ্যালঘুদের কেবল দীর্ঘশ্বাসই ফেলতে হয়। আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার সাথে জামাত শিবির জড়িত কিংবা বিরোধীদলের চক্রান্ত এটি একটি সরকারী ভাষণ এবং এটি বিশ্বাস করার মত এখন আর ধৈর্য বা শক্তি কোনটাই নাই।কেননা, সংখ্যলঘু নির্যাতনের সাথে সর্বদলীয় সরকার এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে প্রশাসন এবং কি অনেক সাধারণ লোকও জড়িত।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন