শনিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশ কি আদৌ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র !!



সেক্যুলারিজম মানে ধর্ম নিরপেক্ষতা।সেক্যুলার শব্দের অর্থ হচ্ছে ইহলৌকিক, ইহজাগতিক, পার্থিব, পরকালবিমুখ, আখিরাত বিমুখ ইত্যাদি।পারিভাষিক অর্থে সেক্যুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে এমন একটি মতবাদ, চিন্তাধারা ও বিশ্বাস, যা পারলৌকিক ধ্যান ধারণা ও ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনভাবে সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হলো একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক দর্শন যা সকল ধর্ম বিশ্বাসকে নাকচ করে দেয়। বাংলাভাষায় Secularism-এর অনুবাদ করা হয়ে থাকে ধর্মনিরপেক্ষতা। এর দ্বার বুঝানো হয়েছে যে, যার ধর্ম তার কাছে, পরধর্ম সহিষ্ঞুতা এর উদ্দেশ্য।

সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ –‘সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা’ নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিৎ।আমি জানি না একজন মানুষের কি ভাবে সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা সম্ভব, ধর্মগুলো তো অনেক সময়েই বিপরীতমুখী কথা বলে।

ইউরোপের রেনেসাই হলো ইহজাগতিকতার বিকাশ। এর ফলে জ্ঞান বিজ্ঞান যুক্তি তর্কের একটা পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ধর্মীয় পীড়নের বিরুদ্ধে একটা জাগতিক মানবতাবাদী জনগোষ্ঠির প্রতিবাদ শুরু হলো। স্ত্রী পুরুষের যৌন মিলন ছাড়াই মেরীর পেটে যিশুর জন্ম হয়। আর সেই যীশুর হাতেই নানান মীরাকেল ঘটনা ঘটে। এই সবই একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষের কাছে মিথ ছাড়া আর কিছু নয়। ইউরোপের মানুষের ধারনায় ও ক্রিয়াকলাপে সেক্যুলারিজম নিশ্চিত ভাবে রূপ পেতে থাকে রেনেসার সময় থেকে। আর তখন থেকে ইউরোপে আধুনিকতার সুত্রপাত হয়। ধর্মীয় অনুশাসনকে উপেক্ষা করে কিছু মানুষ, মানুষ হিসাবে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে শুরু করে। এটা মানুষের মানবমুখী মনোভবের যাত্রা। এটাই ইহজাগতিকতার সাথে সম্পর্ক যুক্ত মানব জীবন। প্রকৃত পক্ষে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, রীতি নীতি, মন্ত্র- তন্ত্র ইত্যাদির দম বন্ধ করা পরিবেশ থেকে মানুষের চিন্তা ও কর্মকে মুক্তি দিয়ে জাগতিক সকল বিষয়ে তাকে উতসাহিত করাই সেক্যুলারিজম।

আসুন ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে কি বুঝায় তা দেখা যাক। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আমরা বুঝি ধর্ম কর্মের স্বাধীনতা। সকল ধর্মে সমান অধিকার। অর্থাৎ ধর্ম নিরপেক্ষতা অর্থ ধর্মহীনতা বা অধর্মতা বুঝায় না। যে যার ধর্ম পালন করবে কিন্তু কারও ধর্মে কেউ হস্তক্ষেপ করবেনা। রাষ্ট্রের সকলের সমান অধিকার সুনিশ্চিত হবে। এটাই হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষতা।



আর এই ধর্ম নিরপেক্ষতা ব্যক্তির চেয়ে রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে খুব বেশী প্রযোজ্য। কারণ রাষ্ট্রের এই মূল নীতিই ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে মানুষকে মানবিক ও ইহোজাগতিক নাগরিকে পরিনত করে। ব্যক্তির ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্ম হীনতা না হলেও এর চরিত্র অন্য রকম যা আজ ধর্মাশ্রয়ী মানুষের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। ধর্ম নিরপেক্ষতা বলতে আমরা কি বুঝি? ধর্মীয় নানা বিধি নিষেধ যদি ব্যক্তির ইহোজাগতিক কাজ কামে বাধার সৃষ্টি করে তাহলে ব্যক্তি যদি নিজের সুখ সাচ্ছন্দের জন্য ঐ সব বিধি নিষিধ উপেক্ষা করে নিজস্ব স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটায় সেই ক্ষেত্রে তাকে সেক্যুলার ধরা হবে। তবে একজন ধার্মিক মানুষ কতটা সেক্যুলার হতে পারে? এক ধর্মে যেটা হারাম করা হয়েছে অন্য ধর্মে সেটা হালাল করা হয়েছে। যেমন হিন্দু ধর্মে গরুর মাংস খাওয়া হারাম আর ইসলাম ধর্মে সেই গরুর মাংস খাওয়াকে হালাল করা হয়েছে। তেমনি এক ধর্মে মূর্তি পুজাকে শিরক আর অন্য ধর্মে সেই মুর্তি পুজাকে ধর্মের অন্যতম অংশ বলে ধরা হয়। এই অবস্থায় দুই ধার্মিকের সহাবস্থান কি ভাবে সম্ভব হবে? এ রকম তীব্র বিপরীত অবস্থায় ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রই নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করবে আইনের মাধ্যমে। আর এই আইন কোন ধর্মাশ্রয়ী আইন নয়। এই অবস্থা রাষ্ট্রীয় আইন মেনে নিয়েই প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ধর্ম পালন করতে পারবে। এর মধ্যে যদি এক ধর্মের কাজ কর্মের কারণে অন্যের ধর্মানুভুতিতে আঘাত আসে সেই ক্ষেত্রে কি হবে? সেই ক্ষেত্রে একমাত্র ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রই নাগরিককে বিচারের কাঠ গোড়ায় দাড় করাবে এবং তাকে মৃত্যুদন্ড দিবে যেটা সৌদি আরব করে যাচ্ছে। আর ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক রাষ্ট্র সেই ক্ষেত্রে নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে।




সব ধর্মের সহাবস্থানই ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ সম্পুর্ণ হয় না। ইহজাগতিক ভাবনার ক্ষেত্রে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রয়োজন অপরিসীম। আর এই ধর্মের থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ সম্পুর্ণ হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা আধুনিক রাষ্ট্রের মূলনীতি বলেই স্বীকৃত হয়। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি একেবারেই অসত্য। ধর্মের সাথে যে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নেই তা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তাই বোঝায় রাষ্ট্রীয় উদযোগের সঙ্গে ধর্মীয় বিষয়ের সংযোগহীনতা, পরলৌকিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কহীন তবে ইহোজাগতিকতাই রাষ্ট্রের প্রধান ধর্ম। ধর্ম থাকতে পারে নাগরিকের ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণের বিষয় হয়ে। রাষ্ট্র সকলকে নিজস্ব ধর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার দেবে সেই সাথে ধর্মহীন বা নাস্তিকের অধিকারও নিশ্চিত করবে সমান ভাবে। তবে রাষ্ট্রের সাথে কোন ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না। একজন নাস্তিক ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে তার মত প্রকাশ করার অধিকার রাখে আর সেই অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব আধুনিক ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রের।

তাহলে কি আমি বলতে চাচ্ছি, রাষ্ট্র ধর্মের বিরোধীতা করবে? একেই কি আমরা ধর্মনিরপেক্ষ বলবো? অবশ্যই না । সমর্থন যেমন একটি পক্ষ, বিরোধীতা ও তেমনি একটি।রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার অর্থ হবে নির্মোহতা,নির্লিপ্ততা । সকল ধর্মের প্রতি সমান কিংবা কোন ধর্মের প্রতি বিশেষ-কোন মডেলেই ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র নামের সংগঠনটির কোন মোহ থাকবেনা, তার কার্যক্রম কিংবা নীতিমালা নির্ধারনে ধর্মের কোন ভূমিকা থাকবেনা । রাষ্ট্র তার নীতিনির্ধারন করবে নাগরিকের বস্তুগত প্রয়োজন মেটানোর জন্য । এই নীতিমালা যদি ধর্মের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন হতে পারে, নাও হতে পারে ।নাগরিক তার খেয়ালখুশী মতো ধর্মপালন করবে, যেমন নাগরিক তার পছন্দমতো খেলাধুলা করে,কাব্য-সংস্কৃতির চর্চা করে অথবা করেনা । রাষ্ট্র এইসবে নাক গলাতে যাবেনা যতোক্ষন না তা রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে সংঘাতপূর্ন হয়ে উঠে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ কথাটির মধ্যে সুক্ষ চালবাজি আছে ।আমাদের সংবিধানের শুরুর কথাটি যদি ধরি, বলা হয়েছে জাতি,ধর্ম,বর্ণ,শ্রেনী,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার।যদি ও পরবর্তীতে অবৈধ সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে সংবিধানের ধারাগুলোকে পরস্পর বিরোধী বানিয়ে ফেলা হয়েছে । সকল ধর্মের অধিকার সমান হলে শুধু ‘‘বিসমিল্লাহির রাহামানির রহিম’’ কি করে যুক্ত হয়?ধর্মকে আশ্রয় করে বাংলাদেশে ব্যাংক বীমা, হাসপাতাল, মসজিদ,মাদ্রাসা,মন্দির,গীর্জা,প্যাগোডা ইত্যাদি গড়ে উঠছে। যেমন বাইতুল মোকাররাম একটা সরকারী কেন্দ্রীয় মসজিদ,ঢাকেশ্বরী মন্দির আরো কত কত।আপনি মসজিদের উন্নয়ন করে,মন্দিরের সংস্কার করে পূন্যবান হবেন, বেহেশত কিংবা স্বর্গে যাবেন যান-কিন্তু তার জন্য আমার করের টাকা ব্যয় হবে কেনো?আমি রাষ্ট্রকে কর দিচ্ছি আমার এবং সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিত করার জন্য।বাংলাদেশ ইসলামিক ফাইন্ডেশন আর একটি সরকারী সংস্থা। এই ভাবে ধার্মিক রাষ্ট্রের সহযোগীতায় অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে যা ধর্ম নিরপেক্ষতার বিপরীত পন্থী ।এইসব প্রশ্ন উত্থাপিত না হলে ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি শুনতে বেশ ভালো লাগে।বেশ একটা ধর্মনিরপেক্ষতার আমেজ ছড়ায়,সকল ধর্মের অধিকার সমান-বাহ ।কিন্তু এই কিসিমের ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে রাষ্ট্র ধরেই নিচ্ছে প্রতিটি মানুষ মাত্রই কোন না কোন ধর্মের অন্তর্গত । ধর্মের বাইরে মানুষের কোন অস্তিত্ব নেই!

ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয় এই দোহাই দিয়েই বাংলাদেশকে আস্তে আস্তে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিনত করা হয়েছে।আমিও তাই বলি, ধর্মনিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়।কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ মানে রাষ্ট্রের সাথে ধর্মের কোন সংশ্লিষ্ট থাকবে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের মূল মন্ত্র ধর্ম নিরপেক্ষতা হওয়া উচিত। যেমনটি আমাদের রাষ্ট্রের ”৭২” এর সংবিধানে অন্তভর্’ক্ত ছিল।কিন্তু সেটা কেবল মাত্র সংবিধানেই আবদ্ধ ছিল বাস্তবে না।তার প্রমান,

“বাংলাদেশ হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে, হিন্দু হিন্দুর ধর্ম পালন করবে। খ্রীস্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নেই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে।“

এ বক্তৃতা থেকে বঙ্গবন্ধুর সর্বধর্মের প্রতি সদয়ের সুর ধ্বনিত হলেও সেক্যুলারিজমের মুল ধারাটি ঠিক অনুধাবিত হয় নি।কারণ ধর্ম বিশ্বাস রাষ্ট্রের জনগণের একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়।১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান ঘোষনা পত্রে আদেশ বলে সংবিধানের প্রস্তবনার পূর্বে ‘‘বিসমিল্লাহির রাহামানির রহিম’’ যুক্ত হলে ধর্মনিরপেক্ষতার জায়গায় এলো সর্ব শক্তিমান আল্লাহের উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’’ এরই ধারাবাহিকতার পথ ধরে ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষনা করেন। রাষ্ট্র একটা ইহোজাগতিক প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কোন পারলৌকিক গত কোন ধর্ম থাকতে পারে না।




মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

বাংলা মায়ের স্বাধীনতা



বর্ষপরিক্রমায় দিন আসে দিন দিন যায়।মহাকালের অনন্ত পরিক্রমায় প্রবাহমান এমনি অসংখ্য দিনক্ষনের হিসাব কে রাখে?তবু বর্ষপঞ্জির শেকেলে বেধে রাখার চেষ্টা করি।২১ শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস,২৫ শে মার্চ সেই ১৯৭১ সালের কালজয়ী বাঙ্গালীর রক্তঝরা বিভীষিকা রাত এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস আমাদের বর্ষপঞ্জির এমনি একটি দিন যা রক্তের আখরে লেখা।এই মহান দিনগুলা আজ শুধু বর্ষপঞ্জিকাতেই দিনকে দিন আটকে যাচ্ছে আমাদের বাঙ্গালী জাতির চেতনায়।

কিন্তু চেতনাতো বসে থাকার পাত্র নয়।খোচা দেওয়াই যার স্বভাব,সংগ্রামই যার লক্ষবস্তু,প্রতিবাদই যার কন্ঠস্বর সেই চেতনা কি আর বসে থাকবে?না তা হতে পারে না।চেতনার মিতালী যাদের সাথে তারা এখনো দূর্বল।কিন্তু চেতনা তো চেতনাই।দূর্বলকে সবল করাইতো চেতনার কাজ।সব কিছুরই একটা শেষ আছে।ইতিহাস তার জন্মাতর থেকে জন্মাতর সাক্ষী হয়ে আছে।আর জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এই যে দূর্নীতি অনিয়ম,ছাত্র রাজনীতির নামে সন্ত্রাসবাদ,গনতন্ত্রের নামে প্রহসন,ক্ষমতার লড়াই,টিকে থাকার রাজনীতি,নতজানু আর রাষ্ট্রনীতি,সর্বপরি স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি এসবই চেতনার ডাইরীতে বড় বড় হেডলাইনে লিপিবদ্ধ।চেতনার সৈনিকেরা একবার জাগবে বেচে থাকার তাগিদে।আর তখনই বাংলার তুরুনেরা সব এক হয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কন্ঠে গেয়ে উঠবে আরো একবার-

“মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত,

যবে উৎপিড়ীতের ক্রন্দন রোল

আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না

অত্যাচারী খড়গ কৃপান ভীম রণ ভূমে রণিবে না

বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত

আমি সেই দিন হব শান্ত।“

কালের আবর্তন তাৎপর্য আমাদের হৃদয়ে বয়ে নিয়ে আসে বিদ্রোহ,আমাদের অনুভূতি ও চেতনার আলোড়ন সৃষ্টি করে।কিন্তু কবির সেই পুরুনো আক্ষেপ আজ সত্যি সত্যি সত্য হয়ে যাচ্ছে আমাদের তরুন সমাজের মাঝে।–

“সাত কোটি সন্তানেরে

হে মুগ্ধ জননী

রেখেছ বাঙ্গালী করে

মানুষ করনি।“

আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন,৬ দফা ১১ দফা আন্দোলন,১৯৭১ সালের মার্চের কালজয়ী বর্বর রাত এবং দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের তাজা রক্ত,মা-বোনের ইজ্জত,বেনটের আঘাতের কথা।আমরা আজ যেন স্বাধীন হয়েও পরাধীনতায় ভুগছি।

যে দেশের জন্য আমার শহীদ ভাইয়েরা সংগ্রাম করল দিনের পর দিন,মাসের পর মাস টানা নয় মাস জীবন বাজি রেখে পাকিস্তানি হানাদারের সাথে ভারি অস্ত্রের মুখে সন্মূখ যুদ্ধ করে স্বাধীন করল আমাদের বাংলা মাকে,যারা গনতন্ত্রের জন্য লাফালাফি করে গনতন্ত্র ফিরিয়ে আনল আজ তারাই গনতন্ত্রের অধিকার থেকে বঞ্চিত।অন্যদিকে যারা আজ এই বাংলার ঘোর বিরোধী ছিল আজ তারাই গনতন্ত্রের পোষক।তারাই আজ দেশের হর্তাকর্তা,মন্ত্রী,আইনের লোক,দেশে বড় বড় জাগায় তারাই আজ সর্বোচ্চ আসন গ্রহন করে আছে।আর যারা এদেশের জন্য তারা আজ অবহেলিত প্রানী বেশ কজন ছাড়া বাকী সকলেই।

১৭৫৭ সালের পলাশীর ষড়যন্ত্র ও প্রহসন মুলক যুদ্ধের করুন পরিনতির সূত্রধরে এবং পরবর্তীতে ভারত উপমহাদেশের মোগল শাসনের অবসানে এ দেশে ইংরেজ শাসনের গোড়াপত্তন যা প্রায় দুইশ বছর স্থায়ী হয়।Quite India আন্দোলনের স্রোতের তোড়ে অবশেষে সব গুটিয়ে সাত-সমুদ্রের ওপারে ইংরেজদেরকে পাড়ি জমাতে হয়।ইংরেজ বিতারনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালে জন্ম নিলো একদিকে হিন্দু অধ্যুষিত ভারত,অন্যদিকে ভারত উপমহাদেশের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নিয়ে পাকিস্তান।কিন্তু সেদিন কে জানত বৃটিশ উপনিবেশক শাসনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিবে পশ্চিম পাকিস্তানী উপনিবেশক শাসনের?কখনও সামরিক শাসনের নামে,কখনও বা গনতন্ত্রের নামে ঘৃন্য অপকৌশল প্রয়োগ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শাসনের নামে শোষন ও বঞ্চনার জঘন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো।গণতন্ত্র আর ইনসাফের মুখে নগ্ন কুঠারঘাত করে রাজনৈতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাহাড় সম বৈষম্য ও আধিপত্য সৃষ্টি করে পাকিস্তানি পূর্ব-পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশকে তাদের দামের উপর নির্ভরশীল করে তুললো।সর্বপরি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এক হীন ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিনত হলো।বাংলার মানুষ এক উপনিবেসের নাগপাশ ছিন্ন করতে না করতেই আর এক জালিমের খপ্পরে পড়ল।প্রথমেই আঘাত পড়ল মাতৃভাষার উপর।এদেশের মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে উঠেপড়ে লাগল উর্দূভাষী পাকিস্তানি জালিম সরকার।তারা এপার বাঙ্গালীর মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পায়তাড়া শুরু করে দিল।
৩৫৪ সেকেন্ডে ১৯৭১


পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের তৎকালীন পূর্ব বাংলার ভাষা দিবস ১১ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স মায়দানে ঘোষনা দিলেন-“Urdu and only Urdu shall be the state language of Pakistan.”২৪ মার্চ তারিখে সেই একই ঘোষনার পুনরাবৃত্তি করলেন কার্জন হল সমাবর্তন অনুষ্ঠানে;রেসসকোর্স ময়দানে ছাত্রদের যে “নো” “নো” প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছিল,তা কার্জন হলে দ্বিগুন ধ্বনিতে উচ্চারিত হলে থমকে যান জিন্নাহ।ছাত্রদের এই সাহসের সূচনাটা করেছিলেন বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার রামরাইল গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।পাকিস্তানের রাষ্ট্রতন্ত্র আবার বাংলা ভাষার উপর আঘাত হানে ১৯৫০ সালে।সেবার গণপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব উপস্থাপিত হয়।ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই প্রস্তাবের তীব্র প্রতিবাদ করে জানান।

সাথে সাথে চেতনা ছুয়ে এলো বাংলা ভাষী শিক্ষিত মহল শিক্ষক এবং ছাত্র জনতার মাঝে।রুখে দাঁড়াল এদেশের দামাল ছেলেরা পাকিস্তানি শোষকের বিরুদ্ধে।রাস্তা,বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবাদ,বিক্ষোবের স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠেছে।অন্যদিকে পাকিস্তানি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করেছে।কিন্তু বাংলার জনগন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যখন মিছিল মিটিং নিয়ে রাস্তায় বের হয় এবং পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রেনের বাইরে চলে যায় তখন গুলি ছুড়ে ছাত্র জনতার উপর।সেদিন সেই রক্তঝরা মিছিলে ভাষার জন্য শহীদ হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, শফিকসহ আরো নাম না জানা অনেকে ।রক্তে রঞ্জিত হলো ভাষা সৈনিকেরা।জেল-জলুম নির্যাতন কিছুই বাদ রইল না।গনদাবীর মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রতন্ত্র ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে বাংলাকে ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃত দেয়।শেষ পর্যন্ত বিজয় হলো চেতনার।বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।

কিন্তু এরপরও আমরা মুক্তি পেয়েও মুক্তি পেলাম না।কারন পাকিস্তানি শাষক সরকার বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে বহুমুখী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।শোষন নিপীড়ন,সর্বস্তরে বৈষম্য আর প্রহসনে অতিষ্ট হয়ে উঠলো বাঙ্গালীর জীবন।পাকিস্তানি সরকার গনতন্ত্রকে হত্যা করে কায়েম করল স্বার্থবাদী চিন্তাধারা।পাকিস্তানি সরকারের এই চিন্তাধারাকে রুখে দিবার জন্য বাংলার বুদ্ধিজীবি,শিক্ষিত মহল,ছাত্রজনতার মাঝে ছুটাছুটি করে দূর্বার আন্দোলনের আয়োজন করে।অবশেষে ফিরে এতে সক্ষম হল গনতন্ত্র বাঙ্গালীর চাপে।এলো ৭০ এর সাধারন নির্বাচন।শুরু হলো জাতীয়তাবাদী চেতনার গনজোয়ার।নির্বাচনে আওয়ামি-লীগ জয়ী হয়।কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামি-লীগের জয়ী হলেও পশ্চি্ম-পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানি বাঙ্গালীর জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইলোনা।অপরদিকে বাঙ্গালী জনতা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য উত্তাল হয়ে উঠলে পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকে।অপরদিকে তখনো ৬ দফা এবং ১১ দফা আন্দোলন তুঙ্গে।সারা বাংলার মানুষ তখন তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে।

জনগনের রায়কে উপেক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার হীন ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি সরকার মেতে উঠে বাংলার জনগনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে।বাঙ্গালী চেতনাকে দুমরে মুচড়ে দেওয়ার জন্য সামরিক শাসন লেলিয়ে দেওয়া হোল।অসংখ্য ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাস ঘাতকতার শেষ পরিনতিতে অবশেষে এলো ১৯৭১ সাল।

শুরু হলো মানব ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়।পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা নিয়ে নতুন করে শুরু হলো লুকুচুরি খেলা।একসময় পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় গোল টেবিল বৈঠক আহবান করলেন।আলোচনা মীমাংসা প্রহসন হলো শুধু।তারপর এলো ২৫ শে মার্চের সেই কালো রাত।শুরু হলো নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর জঘন্যতম নিঃশংস গনহত্যা,ধর্ষন এবং লুন্ঠন।

আওয়ামি-লীগ প্রধান শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানী কারাগারে অন্তরীন করা হল।অন্যান্য আওয়ামী-লীগ নেতৃত্ববৃন্দও রইলেন।গোটা জাতি তখন হতাশা আর দ্বিধাগ্রস্ত।অবশেষে ২৭শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র পাঠ করা হয় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা করলেন জাতীয় মুক্তি প্রত্যাশী স্বাধীনতা পাগল একদল সৈনিক।

বাংলার সর্বত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়লো।জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহন করলেন।গোটা বাংলাদেশকে ৩ টি বিগ্রেড এবং ১১ টি সেক্টরে বিভক্ত করে গেরিলা কায়দায় পরিচালিত হলো হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমন।চললো টানা ৯ মাসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।এ যুদ্ধে দেশের জন্য লড়েছেন সকল স্তরের কৃষক,ছাত্র,শ্রমিক,শিক্ষক,পুলিশ,আনসার,বি.ডি.আর এমনকি সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া আপামর জনসাধারণ।৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ তাজা প্রানের বলিদান আর হাজার হাজার মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের এ বাংলা।অর্জিত হলো আমাদের আকাঙ্ক্ষিত বিজয় ১৬ ই ডিসেম্বর।ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে লেঃ জেনারেল নিয়াজী ও তার সহযোগী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় সূচিত হলো।পৃথীবির মানচিত্রে সংযোজিত হলো আর একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।যার নাম বাংলাদেশ।

সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

শহীদ বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবস



১৯৪১ সালে পাকিস্তানে সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদীর হিন্দু বিদ্বেষ আর ব্রিটিশপ্রীতি ধারণ করে জামায়াতে ইসলামীর জন্ম দিয়েছিলো। বাংলাদেশের জামায়াতীরাও হিন্দু বিদ্বেষে টইটুম্বুর। তদুপরি যেসব প্রগতিশীল চিন্তা- চেতনা এবং উদার সমন্বয়বাদী, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি গড়ে উঠেছে।তারই প্রেক্ষিতে ১৯৪৭ সালে যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা নির্ধারণ করে ভারত ভাগ হয়েছিল, পাকিস্থান নামের এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সেই দ্বিজাতি তত্ত্ব যে এদেশের মানুষের কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারেনি তা অচিরেই প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। এই তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্থানের মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছিল নানা রকম অসঙ্গতি আর অসন্তোষের।কখনও সামরিক শাসনের নামে,কখনও বা গনতন্ত্রের নামে ঘৃন্য অপকৌশল প্রয়োগ করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী শাসনের নামে শোষন ও বঞ্চনার জঘন্যতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো।গণতন্ত্র আর ইনসাফের মুখে নগ্ন কুঠারঘাত করে রাজনৈতিক সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পাহাড় সম বৈষম্য ও আধিপত্য সৃষ্টি করে পাকিস্তানি পূর্ব-পাকিস্তান বর্তমান বাংলাদেশকে তাদের দামের উপর নির্ভরশীল করে তুললো।সর্বপরি আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি এক হীন ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিনত হলো।বাংলার মানুষ এক উপনিবেসের নাগপাশ ছিন্ন করতে না করতেই আর এক জালিমের খপ্পরে পড়ল।প্রথমেই আঘাত পড়ল মাতৃভাষার উপর।এদেশের মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে কেড়ে নিতে উঠেপড়ে লাগল উর্দূভাষী পাকিস্তানি জালিম সরকার।তারা এপার বাঙ্গালীর মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পায়তাড়া শুরু করে দিল।১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে গনদাবীর মুখে পাকিস্তানের রাষ্ট্রতন্ত্র ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রে বাংলাকে ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃত দেয়।শেষ পর্যন্ত বিজয় হলো চেতনার।বাংলা ভাষা পেল রাষ্ট্রীয় মর্যাদা।

কিন্তু এরপরও আমরা মুক্তি পেয়েও মুক্তি পেলাম না।কারন পাকিস্তানি শাষক সরকার বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে বহুমুখী ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।শোষন নিপীড়ন,সর্বস্তরে বৈষম্য আর প্রহসনে অতিষ্ট হয়ে উঠলো বাঙ্গালীর জীবন।পাকিস্তানি সরকার গনতন্ত্রকে হত্যা করে কায়েম করল স্বার্থবাদী চিন্তাধারা।পাকিস্তানি সরকারের এই চিন্তাধারাকে রুখে দিবার জন্য বাংলার বুদ্ধিজীবি,শিক্ষিত মহল,ছাত্রজনতার মাঝে ছুটাছুটি করে দূর্বার আন্দোলনের আয়োজন করে।অবশেষে ফিরে এতে সক্ষম হল গনতন্ত্র বাঙ্গালীর চাপে।এলো ৭০ এর সাধারন নির্বাচন।শুরু হলো জাতীয়তাবাদী চেতনার গনজোয়ার।নির্বাচনে আওয়ামি-লীগ জয়ী হয়।কিন্তু নির্বাচনে আওয়ামি-লীগের জয়ী হলেও পশ্চি্ম-পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানি বাঙ্গালীর জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চাইলোনা।অপরদিকে বাঙ্গালী জনতা নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য উত্তাল হয়ে উঠলে পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকে।অপরদিকে তখনো ৬ দফা এবং ১১ দফা আন্দোলন তুঙ্গে।সারা বাংলার মানুষ তখন তাকিয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর দিকে।

জনগনের রায়কে উপেক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার হীন ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানি সরকার মেতে উঠে বাংলার জনগনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে।বাঙ্গালী চেতনাকে দুমরে মুচড়ে দেওয়ার জন্য সামরিক শাসন লেলিয়ে দেওয়া হোল।অসংখ্য ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাস ঘাতকতার শেষ পরিনতিতে অবশেষে এলো ১৯৭১ সাল।

২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নিরীহ জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণের সময় থেকেই শুরু হয় বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ। পাকিস্তানি সেনারা তাদের অপারেশন সার্চলাইট কর্মসূচির আওতায় চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে বের করে হত্যা করে।১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে ডিসেম্বর জুড়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগী রাজাকার বাহিনী,আল-বদর বাহিনী , আল শামস বাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের উপর নিপীড়ন চালায়।যুদ্ধের প্রথমদিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে হত্যা করা হয়।
তবে বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের তিন চার দিন আগে বিশেষত ঢাকায় ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। ১৪ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় দুই শতেরও বেশি বুদ্ধিজীবীকে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নেয়া হয়।শিক্ষক, সাংবাদিক , চিকিৎসক , চিত্রশিল্পী , প্রকোশলী ও লেখকদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী।আর এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহযোগীতা করে আল-বদর বাহিনী ,আল শামস বাহিনী।সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের উপর গণহত্যা চালায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী।হত্যাকারীরা চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদের তাঁদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে কোনো বিশেষ নির্যাতন কেন্দ্রে নিয়ে যেত।তাঁদের উপর চলত নির্মম দৈহিক নির্যাতন। তারপর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেয়নেটের আঘাতে তাঁদের দেহ ক্ষতিবিক্ষত করে হত্যা করা হতো। বিজয়ের পর বাংলাদেশের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঢাকার মিরপুর , মোহাম্মাদপুর , নাখালপাড়া , রাজারবাগের ডোবানালা, নিচু জমি ও ইটের পাঁজার মধ্যে বুদ্ধিজীবীদের বহুসংখ্যক মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা এবং পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় ক্ষতবিক্ষত এই লাশগুলোর অধিকাংশেরই দেহ ফুলে উঠেছিল।অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।তাঁদের বুকে মাথায় ও পিঠে ছিল বুলেটের আঘাত এবং সারাদেহে বেয়নেটের ক্ষতচিহ্ন।সবচেয়ে নিমর্ম বধ্যভূমি হল- রায়ের বাজার বধ্যভূমি।
৭১ এর  বর্বরতার কথা শুনুন একাত্তরের গেরিলা কমান্ডার শহীদুল হক মামার মুখে।


আজ ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারানোর দিন। বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় যখন নিশ্চিত, ঠিক তখন পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের রাতের আঁধারে চোখ বেঁধে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বুঝতে পেরেছিল, পরাজয় তাদের অনিবার্য। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকলে এ মাটিতে ওরা বসবাস করতে পারবে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশ আবার ফুলে ফলে ভরে উঠবে।কারণ বুদ্ধিজীবীরা পূর্ববাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে বরাবরই ছিলেন তৎপর এবং তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলনে অনুপ্রাণিত করেন। এ কারণে পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীরা বরাবরই ছিলেন পাকিস্তানি শাসকদের বিরাগভাজন। বুদ্ধিজীবী হত্যা স্পষ্টতই ছিল সামরিক জান্তার নীলনকশার বাস্তবায়ন, যে নীলনকশার লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন,মেধাহীন ও পঙ্গু করতে দেশের বরেণ্য সব ব্যক্তিদের রাতের অন্ধকারে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয়।১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকান্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল।

এমনকি পাক-বাহিনীর দোসরদের দ্বারা এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয় ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ থেকে ১৯৭২ এর জানুয়ারী পর্যন্ত।১৯৭১ সালের ২১ শে ডিসেম্বর হত্যা করা হয় ডাঃ মনসুর আলীকে।১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ড. মুর্তজা, ড. আবুল খায়ের ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্যসহ অনেক বুদ্ধিজীবীর গলিত লাশ খুঁজে পাওয়া যায়।৫ জানুয়ারি মিরপুরের বর্তমান শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে গিয়ে তার ভাই গিয়াসউদ্দিন আহমেদের গলিত লাশ পান। লুঙ্গি ও জামা দেখে ভাইয়ের লাশ শনাক্ত করেন তিনি।এবং সাংবাদিক গোলাম রহমানকে ১১ই জানুয়ারী হত্যা করা হয়।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৭১’র ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০,০০০ বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা মতো হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে মেরে ফেলা।



১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’-এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।
বুদ্ধিজীবিদের হত্যা কর হতো যেভাবে


গণতন্ত্রমনা বুদ্ধিজীবীদেরকে বাছাই করে আঘাত হেনেছে। ওই কমিশনের আহবায়ক ছিলেন বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির প্রধান জহির রায়হান বলেছিলেন, এরা নির্ভুলভাবে বাংলাদেশের চলচিচত্রকার জহির রায়হান যিনি নিখোঁজ হন ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি।

চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান তার অপহরণকৃত ভাই শহিদুল্লাহ কায়সারকে (পাক-বাহিনীরা তাকেও হত্যা করেছিল বলে ধারনা করা হয়) খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তাকে শেষ দেখা যায় মিরপুরে বিহারী ও পাক-বাহিনীর দোসরদের ক্যাম্পে। পরবর্তীতে তার সম্পর্কে আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।

পাক-বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস কর্তৃক সংগঠিত তালিকাভূক্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞের স্বরণে বাঙালি জাতি স্বশ্রদ্ধ চিত্তে সেই ১৯৭২ সাল থেকে ১৪ই ডিসেম্বরে শহীদ বুদ্ধিজীবি দিবস পালন করে আসছে । বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ, ১৪ই ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ঘোষনা করেছিলেন কারণ, অপহরণ ও পরে নির্বিচারে হত্যা এই ১৪ই ডিসেম্বরেই অর্থ্যাৎ পাক-বাহিনীর আত্ম-সমর্পন এবং বাঙালির বিজয় অর্জন তথা বিজয় দিবসের ঠিক দু’দিন পূর্বে, সংগঠিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশী।

১৪ই ডিসেম্বর জাতির জন্য একটি অত্যন্ত শোকাবহ দিন। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসর বিশ্বাসঘাতক স্বাধীনতাবিরোধী চক্র–জামাত,আল বদর, আল শামস, রাজাকারদের নজিরবিহীন নৃশংসতা এবং এক ভয়ংকর নীলনকশা বাস্তবায়নের একটি প্রামাণ্য দলিল।

বাঙ্গালীর এই জাগরণে এদেশের সূর্য -সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল আলোকবর্তিকার।ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙ্গালীদের দমিয়ে রাখার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের যে কোন হীন-চক্রান্তের বিরুদ্ধে তাঁরা বারবার সোচ্চার হয়ে উঠেছেন এবং এদেশের সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন।যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।

জাতিকে মেধাশূন্য করার যে প্রক্রিয়া একাত্তরের ঘাতকচক্র শুরু করেছিল তাদের উত্তরসূরিরাও একই উদ্দেশ্যে এই দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে নানা ভুল তথ্য ,ভুল ইতিহাস পরিবেশন করে যাচ্ছে যাতে করে এদেশের মানুষ একটা বিভ্রান্ত জাতিতে পরিণত হয়। এই ঘাতকদালালদের সম্পূর্ণরূপে নির্মুল করা নাহলে জাতির সামনে আরো ভয়াবহ সময় আসবে এতে কোন ভুল নেই।

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হলো গৃহবধূকে





জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিক দিয়ে বিশ্ব অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করলেও এখনো কিছু কিছু নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা মানব সমাজকে তাড়া করে বেরাচ্ছে।এর একটি হচ্ছে নারী নির্যাতন। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী এবং সমাজের উন্নয়নে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু তারপরও সাধারণভাবে তারা শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকারের দিক দিয়ে এখনো পুরুষের সমকক্ষ নয়।বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা।

নারী নির্যাতনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রূপ হচ্ছে স্বামীর হাতে স্ত্রী নির্যাতন।যে নারী ও পুরুষ জীবনে সুখী হওয়ার জন্য সংসার জীবন গড়ে তুলেছেন, তাদের কাছে এই পরিসংখ্যান অত্যন্ত দুঃখজনক।নারী নির্যাতনের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে, শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তার লিঙ্গ নির্ধারণ। দুঃখজনকভাবে এই একবিংশ শতাব্দিতে এমন অসংখ্য মানুষ আছে, যারা গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হলে তাকে মায়ের পেটের মধ্যেই মেরে ফেলতেও কুণ্ঠিত হয় না। একে জন্মের আগেই হত্যা বলে অভিহিত করা যেতে পারে।সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর অগ্রগতি বড় ভূমিকা রাখলেও ঘরের মধ্যে নারীর অবস্থা তেমন বদলায়নি। দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো সময়ে, কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আগে নারীরা মুখ খুলতেন না। ঘরোয়া ব্যাপার বা লজ্জাজনক মনে করতেন। বর্তমানে মুখ খুলছেন। অন্যদিকে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বহুদিন আগে থেকেই কাজ হচ্ছে। কিন্তু নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছেই। এর মূল কারণ হলো, নারী নির্যাতনের কঠোর আইন থাকলেও তা কঠোর ভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি নির্যাতন গুলো চোখের আড়ালে রাখা লোক চক্ষু এবং নারীর আত্মসম্মান বোধের কারনে।তবে সবার আগে প্রয়োজন সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।আর চোখের সামনে নির্যাতন দেখলেও সবাই মেনে নিচ্ছে। দুর্বল আইনের শাসনও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। তাই এ ধরনের সংস্কৃতি যত দিন পরিবর্তন না হবে, তত দিন নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হবে না।
শহরের তুলনায় গ্রামে নারী নির্যাতনের ঘটনা একটু বেশি ঘটে।বয়স অনুযায়ী নির্যাতনের ধরন পাল্টাতে থাকে। আবার যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে অবিবাহিত নারীরা বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিবাহিত নারীরা এর শিকার বেশি হন। মূলত স্বামীর বাড়িতে নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার বেশি হন।জরিপে চার ধরনের নির্যাতনের কথা বলা হয়েছে। যেমন: শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক নির্যাতন।জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ৬৫ শতাংশ বিবাহিত নারী স্বামীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেকই অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হন।এ নির্যাতনও গ্রামে একটু বেশি দেখা যায়।

নারী শিক্ষা এবং তাদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে নারী নির্যাতন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা সম্ভব। তবে সবার আগে সমাজের প্রচলিত ভুল রীতিনীতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে এবং নারীদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। সমাজে নারীকে মানুষ হিসেবে এবং সংসারে নারীকে সম অংশিদারিত্বের মর্যাদা দিতে হবে।

এছাড়া আরো বিভিন্ন ধরনের নারী নির্যাতন সামগ্রিকভাব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে ম্লান করে দিচ্ছে। ফলে, এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার বিষয়ক সব প্রাসঙ্গিক আইনকে আমলে এনে বাস্তবায়ন করতে উদ্যোগী হতে হবে।

নারী নির্যাতন আমাদের সমাজে বেশীভাগ নারী নিজের পরিবারের দ্বারাই নির্যাতিত হয়। কেউ স্বামীর দ্বারাই, কেউ শশুর,শাশুরী,ননদের দ্বারা।কাউকে এসিড মেরে, কাউকে গাছের সাথে বেধে নগ্ন করে পশুর মতো পিটিয়ে। গতকাল সকাল বেলা ফেসবুক এক পেজে দেখলাম, এক নারীকে হাত পা বেধে নগ্ন করে পিটানো দৃশ্যর ভিডিও। দেখে শরীরের লোম শিউরে দাঁড়িয়ে উঠলো।মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে তা ভিডিওটি না দেখলে বুঝবেন না। শাশুড়ি,ননদ, দেবর, শশুর সহ আট-দশজন মিলে অসহায় গৃহবধূ কে দড়ি দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে উলঙ্গ করে ভিডিও করল মোবাইল ফোনে।সেই ভিডিও আবার ইন্টারনেটে ছেড়ে দিল,পাঙ্খা গজাইলে যা হয় আর কি। নিজের ঘরের বউয়ের ইজ্জত নিয়ে যাঁরা তামাশা করল তাঁরা কি মানুষ?তাদের সাথে যদি কোন পশুরও তোলনা করা হয় তাহলে সেই পশুর জাতকেই অপমান করা হবে।কারন অন্যায়কারীর কোন জাত থাকতে পারে না। অসহায় গৃহবধূর উপর যে অন্যায় নির্যাতন করা হয়েছে তা অমানবিক।পশু ছাড়া কোন মানুষ এমনটি করতে পারেনা। এদের বিচার হওয়া প্রয়োজন, কঠিন বিচার। যে বিচার দেখে কেউ এ ঘটনার পূনরাবৃত্তি করার সাহস না পায়। কিছুদিন আগে রাকিব এবং রাজন হত্যা মামলার আসামীদের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় হল।আসুন সবাই মিলে এবার মানুষরুপী এই পশুদেরকে আইনের মুখোমুখি করি।যেভাবে প্রতিবাদ করে ঝড় তুলা হয়েছিল রাকিব,রাজন হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। নির্যাতিত মহিলাটির হাতে সাঁখা ছিল। যা থেকে অনুমান করা যায় যে এটি কোন হিন্দু পরিবারের ঘটনা। তবে হিন্দু বা মুসলিম সে যাই হোকনা কেন সবচেয়ে বড় পরিচয় হল সে একজন বাঙ্গালি নারী। অসহায় এই নারীর প্রতি যে অবিচার করা হল তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া চাই।

শনিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০১৫

দূর্বিত্ত নাকি মৌলবাদী



একদিকে,

নবীর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল ইহুদীরা;

কোরআন আগুনে পুড়িয়েছিল খ্রিষ্টানরা;

কোরআনে প্রসাব করে দিয়েছিল বৌদ্ধরা;

ভারতের বাবরী মসজিদ ভেঙ্গেছিল হিন্দুরা;

ইসলাম ধর্মকে কটুক্তি করে লিখছে নাস্তিকরা;

ইসলামের শরীয়ত মোতাবেক চলে না শিয়ারা।

উপরের সকল কথাগুলা তথাকথিত বাংলাদেশের মডারেট সুশীল মুসলিমরা জোর গলায় প্রচারনা চলায় এবং এই অনৈতিক কর্মকান্ডকে পুজি করে আজও তাদের কাজ বৈধ করে নেয় সুশীল নামধারী মৌলবাদী মুসলিমরা।

অন্যদিকে,

সংখ্যালঘুদের আক্রমন করে বেড়ায় দূর্বিত্তরা;

গির্জায় চার্চের গলা কেটে হত্যা করে দূর্বিত্তরা;

রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলা করেছিল দূর্বিত্তরা;

শিয়াদের মসজিদে আক্রমন করে দূর্বিত্তরা;

নাস্তিক ব্লগার কুপিয়ে হত্যা করে দূর্বিত্তরা;

হিন্দুদের মন্দিরে আক্রমন করে দূর্বিত্তরা।

উপরের সকল কথাগুলা তথাকথিত বাংলাদেশের মডারেট সুশীল মুসলিমরা জোর গলায় প্রচারনা চলায়।কিন্তু তারা মানে মুসলিম ভাইয়েরা কেন বলে না যে,বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর যেসকল আক্রমন হয় তারা কোন না কোন ধর্মের লোক।কেন তাদের দূর্বিত্ত বলে আখ্যায়িত করা হয়?আর তারা কে বা কারা আপনার না বললেও গতকাল জন্ম নেওয়া শিশুটিও বলতে পারে এ আক্রমন গুলা বাংলাদেশী মৌলবাদী মুসলিমদেরই কাজ।অপরদিকে আবার যখন অন্য কোন দেশ বা গোষ্ঠী মুসলিমদের উপর চড়াও হয়ে আক্রমন করে তখন আবার ঠিকই আপনারা তাদের ধর্মকেই টেনে আনবেন সবার আগে।এবং এদেশ থেকে সংখ্যালঘুদের তাড়ানোর জন্য ডাক দিবেন মসজিদের মাইকে মাইকে।আর পরবর্তীতে তা আবার ঢালাও ভাবে প্রচারনা চালানো হবে অমুক সংখ্যালঘু জাতীদের উপর আক্রমন করেছে দুষ্কৃতকারী দুর্বিত্তরা।


কিন্তু অপরদিকে দেখুন-

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া,ভারতে আখলাকের ঘরে গরুর মাংস আছে এই খবরে স্থানীয় গ্রামের শত শত “হিন্দু” মৌলবাদীরা আক্রমন করে,তাকে এবং তার ছেলেকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে বাংলাদেশের সকল নিউজ চ্যানেল এবং নিউজ পোর্টাল প্রচার করে।

অন্যদিকে যখন, ফেনী জেলা সদরের পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারা গ্রামের জেলে পল্লীতে হিন্দু কোজাগরী পূর্ণিমা (শ্রীশ্রীলক্ষ্মী পূজা)-তে আতশবাজি পোড়ানোকে ইস্যু করে চাঁদা দাবী করে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। চাঁদা না পেয়ে এর জের ধরেই পরদিন জেলেপল্লীতে গিয়ে অতর্কিত হামলা করে শারীরিক প্রতিবন্ধী এক জেলের দোকানে লুট পাট, ভাঙচুর শুরু করলে অন্যরা এগিয়ে আসলে এলোপাথাড়ী কোপানো,লাঠিপেটা, কিলঘুষি, লাথি চালাতে থাকে অবিরত।এবং ৭ মাসের গর্ভবতী টুনী রাণীর গর্ভপাত হয়ে যায় লাথির আঘাতে।কিন্তু সেটাও প্রচার করা হলো দূর্বিত্ত এবং ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসী বলে।কিন্তু কেন তারা যে “মুসলিম” এবং “ধর্ম”-কে কেন্দ্র করেই মুলত এ আক্রমন করা হয় তা কেন প্রচার করা হলো না?

আমীর খান কিছুদিন আগে বলেছেন- ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমে যাচ্ছে এবং অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।এই নিয়ে বাংলাদেশী অনেক মডারেটর বলছেন সেই তুলানায় বাংলাদেশে হিন্দুরা অনেক ভালো আছে।আবার অনেকে আমীরের বিপক্ষেও মন্তব্য করেছে।

এই মতামতের বিরোধীতা করে ধর্মান্ধ মৌলবাদী “হিন্দু” শিবসেনা গ্রুপের শীর্ষনেতা রাজ থ্যাকারে এই ধরণের মতামত দেয়ার কারণে আমীর খানকে হত্যার হুমকি দিয়েছে। সেই সাথে এটাও বলেছে, যারাই এই ধরণের কথা বলবে সবাইকেই হত্যা করা হবে।

কিন্তু আবার যখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলোক সেনকে দা দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয় তখন সেটা প্রচার করা হলো “দূর্বিত্ত”-দের আক্রমনের শিকার বলে।কিন্তু কেন সেটা ইসলামী মৌলবাদের আক্রমন ফলে প্রচার করা হলো না?

এরকম হাজার হাজার উদাহরণ দেওয়া যাবে,কিন্তু এই “দূর্বিত্ত” শব্দটি পরিবর্তন করে বাংলাদেশে “ইসলামী মৌলবাদী” শব্দটি কী আদো ব্যবহার করা যাবে কখনো?

মঙ্গলবার, ২৪ নভেম্বর, ২০১৫

হিন্দু ধর্মের এক বর্বর প্রথার নাম সতীদাহ



ধর্মের প্রতি মোহমুক্ত হয়ে তাকালেই দেখা যায়, ধর্মকে যতটা মানবিক হিসেবে প্রচার করা হয়, আসলে তা নয়। ধর্মটা মনুষ্যত্বের নয়, কতিপয় গোষ্ঠীর-গোত্রের। ধর্ম মানুষের মাঝে একতা গড়ে তোলে না, আনে বিদ্বেষ; যা আসলে উগ্র, হিংস্র, জংলী আচরণে পর্যবসিত হয়। কোনো ধর্মই গণমানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির পথ দেখায়নি।কিন্তু ধর্মবাদীরা মাঝেমাঝে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে মিলে-মিশে থাকার কথা ঘোষণা করেন, শান্তিবাদী হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে্ন, সেটা একটা ফন্দী মাত্র কেবল। কারণ জগতে ধর্মের নামে, এক ধর্ম অন্য ধর্মের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব-কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে মানব সভ্যতার গোড়া থেকেই অগণিত, অসংখ্য মানুষ খুন করেছে এবং আজও সে ধারা অব্যাহত আছে। ফলে ধর্ম আজ মানব-সভ্যতার কলঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে।

সনাতন ধর্ম হলো পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ধর্ম। এর আরেক নাম হলো হিন্দুধর্ম। এই ধর্মের ধর্মগ্রন্থের সংখ্যা অনেক বেশি।তাই আমি বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থের আলোকে হিন্দু ধর্মের সতীদাহ প্রথা নিয়ে সংকলিত করব-

সনাতন সমাজে সব চেয়ে খারাপ এবং বর্বর প্রথা হিসেবে গণ্য হয়েছে সতীদাহ প্রথা। স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে জোর পূর্বক স্বামীর সাথে চিতায় ভস্ম করা ছিল এই প্রথা। ব্রিটিশ শাসনামলে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রাজা রাম মোহন রায়ের ঐকান্তিক চেষ্টায় ব্রিটিশ সরকার আইনের মাধ্যমে এ প্রথাকে রদ করে।সতীদাহ প্রথা কুপ্রথা হিসেবে প্রকটরূপ ধারণ করে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে। সতীদাহ প্রথা বেশি প্রচলিত ছিল সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মাঝে, যেমন- ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়।

সনাতন ধর্মানুসারী অনেক প্রগতিশীল মানুষ দেখেছি, যাঁরা বলেন, হিন্দুধর্ম নারীকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করেছে। ইসলামী মৌলবাদ নিয়ে সারা বিশ্বের মানুষ ও গণমাধ্যমগুলো ব্যস্ত থাকার কারণে এইসব তথাকথিত প্রগতিশীল হিন্দু সমালোচনা করে ইসলামিক শরিয়া আইন ও নারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করাকে। কিন্তু তারা সমালোচনা করে না সতীদাহ প্রথার। আবার অনেকে স্বীকারই করে না যে, সতীদাহ প্রথা বলতে কিছু ছিলো হিন্দু ধর্মে।আবার যারা স্বীকার করেও নেয় তারা বলে এটা আসলে একটা প্রথা ছিল,এখানে ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থের কোন হাত ছিল না।যা কেবল ছিল কিছু গোত্র কিংবা অঞ্চল ভিত্তিক।তাহলে আসল সত্যটা কি তা জেনে নিই আসুন-

স্বামীর শব দাহের সঙ্গে বিধবা স্ত্রীকে জীবন্ত দাহ করার পূর্বেকার হিন্দুধর্মীয় প্রথা। সংস্কৃত ‘সতী‘ শব্দটি আক্ষরিক অর্থে এমন সতীসাধ্বী রমণীকে বোঝায় যিনি তার স্বামীর প্রতি চূড়ান্ত সততা প্রদর্শন করেন এবং তার আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিও থাকেন সত্যনিষ্ঠ। কিন্তু একটি আচার হিসেবে সতীদাহের অর্থ হলো মৃত স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর সহমরণের ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা এবং ওই অনুষ্ঠানে তূরীবাদক জনতার মাঝে স্বামীর শেষকৃত্যের চিতায় আরোহণ করা। কবে এবং কিভাবে এ ধরনের আচার ধর্মীয় প্রথারূপে গড়ে উঠেছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

হিন্দু নারীরা কি স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় ওঠে যেতেন? মোটেই তা নয়। ঐতিহাসিকগণ জানিয়েছেন, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সদ্য বিধবা নারীকে উত্তেজক নেশা জাতীয় পানীয় পান করিয়ে কিংবা নেশা জাতীয় দ্রব্য শুঁকিয়ে অজ্ঞান করে কিংবা অর্ধচেতন অবস্থায় স্বামীর চিতায় তুলে দেওয়া হতো।

কোন একজনের ফেসবুক পোস্টে পড়েছিলাম, “যে নারী স্বামীর চিতায় আত্মোৎসর্গ করে সে তার পিতৃকুল, স্বামীকুল উভয়কেই পবিত্র করে।” যেমন করে সাপুড়ে সাপকে তার গর্ত থেকে টেনে বার করে তেমনভাবে সতী তার স্বামীকে নরক থেকে আকর্ষণ করে এবং সুখে থাকে। ব্রহ্মপুরাণ বলে, “যদি স্বামীর প্রবাসে মৃত্যু হয়ে থাকে তবে স্ত্রীর কর্তব্য স্বামীর পাদুকা বুকে ধরে অগ্নিপ্রবেশ করা।”(ভারতের অন্যতম মানবতাবাদী লেখক ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য,প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪৭)

“সদ্যবিধবা নারী নববধূর মতো সাজে, তার শ্রেষ্ঠ পোষাক পরে, সিঁদুর, কাজল, ফুলমালা, চন্দন, আলতায় সুসজ্জিত হয়ে ধীরে ধীরে সে চিতায় ওঠে, তার স্বামীর পা দুটি বুকে আঁকড়ে ধরে কিংবা মৃতদেহকে দুই বাহুতে আলিঙ্গন করে, এইভাবে যতক্ষণ না আগুন জ্বলে সে বিভ্রান্তির সঙ্গে অপেক্ষা করে। যদি শেষ মুহূর্তে বিচলিত হয় এবং নীতিগত, দৃশ্যগতভাবে ছন্দপতন ঘটে তাই শুভাকংখীরা তাকে উত্তেজক পানীয় পান করান। এমন কি পরে যখন আগুনের লেলিহান শিখা অসহনীয় হয়ে ওঠে, পানীয়র নেশা কেটে যায়, তখন যদি সেই বিধবা বিচলিত হয়ে পড়ে, ‘সতী’র মহিমা ক্ষুণ্ন হবার ভয় দেখা দেয় তখন সেই শুভাকাংখীরাই তাকে বাঁশের লাঠি দিয়ে চেপে ধরে যদি সে চিতা থেকে নেমে আসতে চায়, প্রতিবেশী, পুরোহিত, সমাজকর্তা সকলেই অনুষ্ঠানের সাফল্যের জন্য অতিমাত্রায় সাহায্য করতে চায়। তারা গান করে, ঢাক বাজায় এতো উচ্চ জয়ধ্বনি দেয় যে সতী যা কিছু বলতে চায় সবই উচ্চনাদে ঢেকে যায়।” (ভারতের অন্যতম মানবতাবাদী লেখক ড. সুকুমারী ভট্টাচার্য,প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ, পৃষ্ঠা ১৪৭)
স্বত:প্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুতে স্ত্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত। পৌরাণিক কাহিনীতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পান্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহূতু পান্ডুকে যৌনসহবাসে মৃত্যুদন্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। রাজপুতানায় "জহর ব্রত" প্রচলিত যাতে কোন শহর দখল হবার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকেসহমরণএ বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারতো।(সূত্রঃউইকিপিডিয়া)

পরাশর সংহিতায় পাই, “মানুষের শরীরে সাড়ে তিন কোটি লোম থাকে, যে নারী মৃত্যুতেও তার স্বামীকে অনুগমন করে, সে স্বামীর সঙ্গে ৩৩ বৎসরই স্বর্গবাস করে।” (৪:২৮)

ষষ্ঠশতকের বরাহমিহির তার বৃহৎসংহিতায় বলেন, “অহো নারীর প্রেম কি সুদৃঢ়, তারা স্বামীর দেহ ক্রোড়ে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে।” (৭৪:২৩)

মহাভারতের মৌষল পর্বে আমরা দেখি, ভগবান কৃষ্ণের মৃত্যুর পর তাঁর চার স্ত্রী রুক্কিণী, রোহিণী, ভদ্রা এবং মদিরা তাঁর চিতায় সহমৃতা হয়েছিলেন। এমন কি বসুদেবের আট পত্নীও তাঁর মৃত্যুর পরে সহমরণে গিয়েছিলেন। ব্যাসস্মৃতি বলছে, চিতায় বিধবা নারী তার স্বামীর মৃতদেহে আলিঙ্গন করবেন অথবা তার মস্তকমুণ্ডন করবেন। (২:৫৫)

হিন্দুধর্মের ইতিহাসে সনাতন ধর্ম শাস্ত্র কি বলে আসুন জেনে নিই এবার-

ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।(অথর্ববেদ ১৮.৩.১)

অর্থঃ হে মনুষ্য! এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।

অথর্ববেদ ১৮.৩.২ (এই মন্ত্রটি ঋগবেদ ১০.১৮.৮ এ ও আছে)

উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপশেষ এহি। হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব।(অথর্ববেদ ১৮.৩.২;এই মন্ত্রটি ঋগবেদ ১০.১৮.৮ এ ও আছে)

অর্থঃ হে নারী! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কি?বাস্তব জীবনে ফিরে এস। পুনরায় তোমার পাণিগ্রহনকারী পতির সাথে তোমার আবার পত্নীত্ব তৈরী হবে।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমি এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে,সতীদাহ কেবল একটা প্রথাই না,যা অনেক বড় বর্বর ধর্মীয় কুসংস্কার এবং একমাত্র ধর্মান্ধরাই মেনে নিতে পারে এমন অমানবিক পথ,কিছু মাত্র লোকের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্ররোচনায় পরে।

এই বাংলায় ১৮১৫ সাল থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তের বছরে ব্রাহ্মণ্যবাদীর দল পুণ্যলাভের আশায় আর নারীর সতীত্ব রক্ষার ধুয়া তুলে ৮১৩৫ জন নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে সতী বানিয়েছিল! একটু ভাবুন তো, একটি নিরাপরাধ মেয়েকে টেনে-হিচড়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলছে, পাশে মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন সবাই দাঁড়িয়ে ‘বল হরি বল’ কীর্তন গেয়ে নিজেদের স্বর্গে যাবার আয়োজন করছে, ভাবতেই অবাক লাগে।

আফিমীয় মাদক মানুষকে কতটুকু নিবোর্ধ-মানবিকতাশূণ্য বানিয়ে দেয়, তারই উদাহরণ হতে পারে উপমহাদেশের এই সতীদাহ প্রথা।ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে “ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” সরকার প্রথম দিকে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডে উদারপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং উনিশ শতকের বিশের দশকে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের ভিত মজবুত হওয়ার পর সরকার কিছু জনহিতকর আইন প্রণয়নে চিন্তাভাবনা শুরু করে। খ্রিস্টান মিশনারি, ঈঙ্গ-ভারতীয় সংবাদপত্র এবং রাজা রামমোহন রায়সহ কতিপয় দেশীয় সংস্কারবাদী জনহিতকর সংস্কারের পক্ষে সমর্থন যোগান। অবশেষে নিজ দেশের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক (১৮২৮-১৮৩৩) রেগুলেশন XVII, ১৮২৯ পাস করেন। বেন্টিঙ্ক নিজেও একজন মানবহিতৈষী সংস্কারপন্থী ছিলেন। এই আইনে ‘সতীদাহ প্রথা বা হিন্দু বিধবা নারীকে জীবন্ত দাহ বা সমাধিস্থ করা বেআইনি বলে ঘোষণা করা হয়।

বুধবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৫

মুক্তচিন্তা মুক্ত হোক



শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড।শিক্ষিত জাতি পারে একটি সুখী সুন্দর সাবলীল রাষ্ট্র উপহার দিতে।একটি জাতিকে প্রসারিত করতে পারে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি প্রয়োজন চিন্তার বিকাশ প্রসারণ। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পুঁথিগত বিদ্যা হয়তো মুখস্ত করলেই পাওয়া যায়। কিন্তু সৃজনশীল ও মুক্তচিন্তা মানুষকে কষ্ট করেই অর্জন করতে হয়। তাই মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে শিশুকাল থেকেই শিক্ষার প্রকৃত অর্থটা বোঝানোই হতে পারে মুক্তচিন্তার প্রাথমিক ধাপ। আধুনিক সমাজে মুক্তবুদ্ধি চর্চা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাড়ায় মুক্ত চিন্তার ক্ষমতা। সুশিক্ষার হার বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে সচেতনতার হার, বাড়ে যুক্তি দিয়ে কাজ ও চিন্তা করার ক্ষমতা, এবং কমে অন্ধ বিশ্বাসের পরিধি।আজকাল মুক্তচিন্তা বিষয়টি বারবার আলোচিত এবং সমালোচনা হচ্ছে পুঙ্খানোপুঙ্খ ভাবে।যে জাতি যত বেশী মুক্তভাবে জ্ঞান চর্চা করতে পারছে সে জাতি তত বেশী সভ্য এবং প্রগতিশীল জাতি হিসাবে পরিচিত লাভ করতে পেরেছে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে।

উইকিপিডিয়া বলছে, মুক্তচিন্তা হলো এক প্রকার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী। যা বলে যে, বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা এবং যুক্তির আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। মতামত গঠনের ক্ষেত্রে প্রথা, অন্ধ বিশ্বাস এবং কর্তৃপক্ষ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া উচিত নয়। সচেতনভাবে মুক্তচিন্তার প্রয়োগকে বলে মুক্তচিন্তন এবং এর অনুশীলনকারীদের বলে মুক্তমনা।

মনোবিজ্ঞানীরা আরও বলেন, মুক্তচিন্তার অধিকারী হতে হলে একজন মানুষের কখনোই জ্ঞান ও যুক্তিহীন দাবিকৃত কোনও মতকেই সত্য হিসেবে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করা উচিত না। সুতরাং মুক্তমনারা বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, বাস্তব সত্য এবং যুক্তির আলোকে মত গড়ে তুলবেন।অথবা কর্তৃপক্ষ, পক্ষপাতদুষ্টতা, লোকজ্ঞান, জনপ্রিয় সংস্কৃতি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, প্রথা, গুজব এবং অন্য সব গোঁড়া, বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রতিবন্ধকতার উৎসাহদাতার ভূমিকা পালনকারী জিনিস থেকে নিজেদের বিরত রাখবেন। ধর্মের ক্ষেত্রে মুক্তমনারা সাধারণত সমস্ত অলৌকিক বিষয়াবলি এড়িয়ে চলে তার পেছনের যুক্তি খুঁজে বের করবেন। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে-মানুষ ধর্মের জন্য নয় বরং মানুষের জন্যই ধর্ম।

মানুষ চিন্তাশীল প্রাণি। সে তার জীবন, জগৎ, সমাজ, রাষ্ট্র, বিশ্ব নিয়ে চিন্তা করে। কেননা সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্বের যে ঘটমান-রূপান্তর তা কোনো-না-কোনোভাবে তার জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং কোনো-না-কোনোভাবে তার জীবনে প্রভাব বিস্তার করে।বিশ্বব্যাপী মুক্তভাবে চিন্তা করা এবং নিজের চিন্তা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত।

যুগ এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তি আর যোগাযোগে সভ্যসমাজ হয়ে উঠছে আধুনিক। অথচ এই একুশ শতকে এসেও আজ পৃথিবী ধুঁকছে মুক্তচিন্তার অভাবে। দেশে দেশে যেমন ছড়িয়ে পড়েছে কট্টরপন্থিতা, ধর্মীয় মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ। তেমনি সমাজে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অন্যের মত ও পথের প্রতি সহনশীলতার অভাব, হানাহানি।মুক্তচিন্তা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সোস্যাল মিড়িয়ার দ্রুততম যোগাযোগের সৌজন্যে একটি প্রযুক্তিগত ন্যায্যতা পায়। বিশ্বব্যাপী মিডিয়া অধ্যয়নে সোস্যাল মিডিয়া সেভাবেই বিরাট জায়গা দখল করে নিচ্ছে। কেননা সমাজের গতিশীলতায় নতুন মাত্রা যোগ করার ক্ষেত্রে সোস্যাল মিড়িয়া একটি অভূতপূর্ব প্রভাব-বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে ইতোমধ্যে তার ক্ষমতা প্রমাণ করেছে।তৃতীয় কিংবা চতুর্থ বিশ্বের কোনো প্রত্যন্ত প্রান্তের কোনো প্রান্তিক মানুষের মতামত সোস্যাল মিড়িয়া হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য প্রত্যন্ত প্রান্তরে।

তবে মুক্তচিন্তা সবসময় মুক্ত ছিল না। এখনও নেই। মুক্তমনাদের ওপর আঘাত এসেছে বারবার। চিন্তা যত যৌক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ হোক, তা মেনে নিতে চান না অনেকেই। বিশেষ করে ধর্মান্ধরা মুক্তচিন্তার বিরোধিতা করেছেন বরাবরই। বিশেষ কোনো মতবাদের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস থেকে অন্য মতবাদকে বাতিল করতে চেয়েছেন বারবার। তারা চিন্তা দিয়ে চিন্তার জবাব দেননি, জবাব দিয়েছেন অস্ত্র দিয়ে। কারণ, তারা নতুন করে চিন্তা করতে পারেন না বা করেন না। মুক্তভাবে চিন্তা করা পছন্দও করেন না তারা। বিজ্ঞান অন্ধকার পথকে আলোকিত করে সঠিক পথের সন্ধান দেয়, অজানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে রক্ষণশীল সমাজের সত্যের মুখোশ উন্মোচন করে দেয়। স্বার্থে আঘাত লাগে বলে রক্ষণশীলরা বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়, বিজ্ঞানের চিন্তাকে যারা ধারণ করে, লালন করে তাদের উপর অত্যাচার চালায়, কখনো কখনো জীবননাশের পথও বেছে নেয়।

সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে নাকি পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে — এই প্রশ্নে যদি কেউ বলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে — তাহলে লোকে তাকে নির্ঘাত আজ পাগল ভাববে। অথচ একসময় এই ধারণাই ছিল প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠিত সেই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ব্রুনো, কোপার্নিকাস বলেছিলেন — পৃথিবী-ই সূর্যের চারদিকে ঘোরে। গাণিতিকভাবে তা প্রমাণও করে দেখিয়েছেন। এই সত্য আবিষ্কার ও প্রচারের কারণে ধর্ম যাজকরা ব্রুনোকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ছিল। গ্যালিলিওকে সারাজীবন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করতে হয়েছিল।এসব মহান মানুষ সরাসরি ধর্মের বিরোধিতা করেননি। কিন্তু মণীষীদের বক্তব্য ধর্মান্ধদের বিশ্বাসের বিপরীত হওয়ায়, তাদের হেনস্তা এমনকি হত্যা করা হয়।

সব ধর্মেরই লক্ষ্য পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা।প্রত্যেক ধর্মেরই অসংখ্য ধার্মিক পণ্ডিত আছেন।তারা ভালো বলতে পারেন, লিখতে পারেন। ধর্মবিরোধী কোনো বক্তব্যের জবাব তারা মুখে কিংবা লিখে দিতে পারেন। এ দেশে নাস্তিক পণ্ডিতের চেয়ে আস্তিক পণ্ডিতের সংখ্যা অনেক বেশি। সব ধার্মিক পণ্ডিত যদি লিখতে থাকেন, তাহলে তো ধর্মে অবিশ্বাসী বা ধর্মবিরোধী চিন্তাবিদরা পাত্তাই পাবেন না।

ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষা দেওয়া অন্যায় নয়।কোরআন, গীতা, ত্রিপিটক, বাইবেলের মতো গ্রন্থ যে পবিত্র তা আমরা জন্ম থেকে জেনে আসি না। কেউ পরিচয় না করিয়ে দিলে ধর্ম কি তা আমরা জানতাম না। জন্মের পর আমাদের আশেপাশের মানুষ-ই আমাদেরকে এসবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আর আমরা প্রায় সবাই ধর্ম না বুঝে শুধুমাত্র তাদের ওপর আস্থা রেখেই তা মানা শুরু করেছি। ধর্মের ব্যাপারে শুরু থেকেই শোনা কথার ওপর আস্থা রাখার এই মানসিকতা আমাদের আজও রয়ে গেছে।

অন্য দিকে, ‘অন্ধত্ব’ শুধু ধর্মানুসারীদের জন্যই প্রযোজ্য নয়। ‘ধর্মান্ধ’ আস্তিক যেমন আছেন, তেমনি কট্টরপন্থি নাস্তিকও রয়েছেন। ধর্মানুসারীদের যেমন উচিত ‘ধর্মান্ধতা’ পরিহার করা, তেমনি নাস্তিকদেরও উচিত নাস্তিক্যের ‘অন্ধত্ব’ থেকে বেরিয়ে আসা। উভয় পক্ষেরই উচিত পরমত-সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করা। অপরের কথা শোনা এবং বোঝার মানসিকতা থাকতে হবে।

আমরা কেউ পর্যাপ্ত মাত্রায় সহনশীল নই। সহনশীলতা শুধু ধর্মান্ধদের পক্ষ থেকেই প্রত্যাশিত না, প্রগতিশীলদের কাছ থেকেও সমমাত্রার সহনশীলতা কাম্য। বিকৃত বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করলেই যে তর্কযুদ্ধে জয়লাভ ঘটে না, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু মুক্ত আলোচনার নামে আমরা এসব করে থাকি। এটা হলো রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের সূচনা।ক্রোধ মানুষকে অমানুষে পরিণত করে। অমানুষের মধ্যে কোনো মানবিকতা থাকে না।

মুক্তচিন্তা মানে সমস্ত অজ্ঞতা-ধর্মীয় গোঁড়ামি-কুসংস্কার-পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা।এর মানে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় চিন্তা না করেই খেয়াল-খুশি মতো যেকোন কিছু করা বা বলা নয়। অনেকেই মুক্তচিন্তা বলতে ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম করে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করাকে বোঝেন, কোনো নিয়ম না মানাকে বোঝেন। তারা এই সত্যটি ভুলে যান যে, জাগতিক কোনো কিছুই নিয়মের বাইরে নয়, সবকিছু নিয়মের শাসনাধীন।সমাজ বিকাশের নিয়ম মেনে চিন্তা ও কাজ করতে পারার নামই প্রগতিশীলতা।

মুক্তচিন্তার প্রতিপক্ষ ধর্ম নয় কোনভাবেই। ধর্ম ক্ষেত্র বিশেষে কিছু প্রতিবন্ধকতা তৈরী করতে পারে মাত্র। আজকের দুনিয়ায় মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানের প্রতিপক্ষ প্রকৃতপক্ষে শাসকগোষ্ঠী আর সাম্রাজ্যবাদ যার দখলে আছে রাষ্ট্রযন্ত্র আর কর্মকৌশল। তারাই দখল করেছে চিন্তা-জ্ঞান আর বিজ্ঞানকে। এই দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্যই তারা ধর্মকে ব্যবহার করছে।ধর্ম একটা বিশ্বাস।আর এই বিশ্বাসকে পুঁজি করেই প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তি ধর্মীয় গোঁড়ামিকে কাজে লাগিয়ে দেশে প্রতিনিয়ত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে চলেছে।তাদেরকে প্রথমে তাদের নিজেদের জ্ঞানের ভিতকে সুসংহত করতে হবে। বুঝত হবে, ধর্মীয় কুসংস্কার ও ধর্মের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ আর ধর্মীয় মূল্যবোধকে অবমাননা করা এক নয়।

পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুক্ত চিন্তাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়। নতুন নতুন চিন্তাই দুনিয়াকে এগিয়ে নেবে। মানুষ হবে মুক্তচিন্তার জোরেই। সুতরাং মুক্তচিন্তা মুক্ত হোক।