শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫

বিষয় যখন নারীর পিরিয়ড



পিরিয়ড প্রত্যেক সুস্থ স্বাভাবিক নারীর জীবনে একটি অতি স্বভাবিক ব্যাপার এবং নারী স্বাস্থ্যের ভীষন গুরুত্বপূর্ন একটি দিক। পিরিয়ড,ব্যাপারটা প্রকৃতি প্রদত্ত। প্রত্যেকটা মানব সন্তানের জন্ম হওয়ার প্রথম এবং প্রধান সোপান এটা। কিন্তু এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা এটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছি না। পিরিয়ড নামক শব্দটা কারো মুখে শোনা মাত্রই তার দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে ভুল করিনা।যেন এটা খুব লজ্জার কথা।যদি কোন মেয়ের আকস্মিক ভাবে পিরিয়ড হয়,এবং তার কাপড়ে কোন রক্তের দাগ দেখতে পাই তাহলে বড়রা থেকে শুরু করে ছোট ছোট বাচ্চারা পর্যন্ত সেই কাপড়ে লেগে থাকা রক্ত নিয়ে মেয়েকে ইঙ্গিত করে চোখ টিপাটিপি করি।সত্যি কথা বলতে,আমিও করছি আমার কোন বন্ধুর কাপড়ে লেগে থাকা তাজা রক্তের দাগ নিয়ে এবং সাথে আমার সকল বন্ধুরা।সেই দিনটা ঐ মেয়েকে নিয়ে আমরা হাসাহাসি করে যে কত মজা পাইছিলাম তা বলে শেষ করা যাবে না।তবে আমাদের সারাদিনের টপিক ছিল ঐ মেয়ে বন্ধুর কাপড়ে তাজা রক্তের দাগ লাগা নিয়ে।যাকে কাছে পাইছি তাকেই বলছি অধীর আগ্রহ নিয়ে আজ অমুকের পিরিয়ড হইছে।জামা,ব্রেঞ্চে রক্তের দাগ দেখছি আমরা।কারন আমাদের সমাজটাই শিখাইছে এরকম।কিন্তু এখন দিন বদলাইছে,সময় বদলাইছে। তারপরেও দোকানে ন্যাপকিন কিনতে যাওয়ার পর দোকানীর বাঁকা চাহনি,চাপা হাসি,অতি উৎসাহী মুখ,চুপিসারে ক্রেতার হাতে গুঁজে দেয়া প্রভৃতি ঘটনার সম্মুখীন প্রায় সব মেয়েকেই হতে হয়।

রেনেসাঁ যুগে নারীর ঋতুস্রাবের রক্তের প্রতি মানুষের ঘৃণা এবং ভয় এতো বেশি ছিলো যে একে বিষ বলে ধারণা করা হতো। বলা হতো এই বিষ থেকে তৈরি হয় বিষাক্ত বাষ্প এবং তা নারীর মাঝে হিস্টেরিয়ার উদ্রেক করে। বিংশ শতাব্দীতে এসে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। এখনো পর্যন্ত ইন্ডিয়ার কিছু জায়গায় ঋতুস্রাবের প্রতি আছে ভীষণ ট্যাবু। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন যে ঋতুস্রাব চলাকালীন সময়ে কোনো নারী রান্না করলে সেই খাবার খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যাবে। কিছু কিছু জায়গায় এমনও নিয়ম আছে যে এই সময়টা নারীকে কাটাতে হবে গোয়ালঘরে।এছাড়াও আছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে মেয়ের পিরিয়ড নিয়ে নানা কথা।তবে গ্রন্থ গুলোর একটা কমন তসবি হচ্ছে পিরিয়ড চলা কালীন মেয়ে অপবিত্র থাকে এবং সেই সময় তারে দিয়ে কিছু করা বা ধর্মীয় কোন কাজ করানো যাবে না।এই শতাব্দীতে একটি ভয়াবহ কুসংস্কার প্রচলিত আছে যে,নারীর পিরিয়ড চলাকালীন সময় যদি কোন পুরুষ ঐ নারীর সাথে সঙ্গমে মিলিত হয় তাহলে সেই পুরুষের লিঙ্গ ছোট হয়ে যাবে।অথচ বিজ্ঞান সম্মত ভাবে কথাটা কেবল উদ্ভটই হিসাবে প্রমানিত হয়।

নারী হয়ে জন্ম নেবার কারণে জীবনে একবার হলেও নিজেকে অভিশাপ দেননি, এমন নারী হয়তো বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে খুব কম।নারীদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, পিরিয়ড বা ঋতুস্রাব নিয়েই বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত ছিল ভয়াবহ সব কুসংস্কার যা এখনো বজায় আছে বহাল তবিয়তে। দেখুন কালের সাথে সাথে কী করে বদলেছে এসব কুসংস্কার ও ভুল ধারণা। বদলে গেলেও মানুষের মধ্য থেকে পিরিয়ড নিয়ে ভয় ও ঘৃণা দূর হয়নি মোটেই। আপনার আশেপাশে এমনকি আপনার পরিবারের পুরুষ এমনকি নারীদের মাঝেও রয়েছে এমনই সব কুসংস্কার। আজ থেকে দু-হাজার বছর আগে, যাকে বলা হতো Biblical Times, এ ঋতু চলাকালীন সময়ে সেই নারীকে এতোটাই অচ্ছুৎ, অস্পৃশ্য মনে করা হতো যে এই পুরো সময়টা তাকে পরিবার থেকে আলাদা থাকতে হবে।পিরিয়ড ঋতুচক্র নারী জীবনের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পূর্বে ধারণা করা হতো পিরিয়ড অনেক অপবিত্র একটি বিষয়। কিন্তু বর্তমানে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। কোনো নারীর নিয়মিত পিরিয়ড হওয়ার অর্থ তিনি স্বাভাবিকভাবে সন্তান ধারণে সক্ষম।

একটা মেয়ের পিরিয়ড চলাকালীন সময়ে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মধ্যে চলতে হয় এবং কমবেশী নানা দূর্ভোগ পোহাতে হয়।এই সময় মেয়েদের জরায়ু দিয়ে অনেক রক্তপাত হয়,অনেকের মেজাজ খিট খিটে হয়ে যায়,পেটে ব্যাথা অনুভব করে,মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি।পিরিয়ড সম্পর্কে নানা ভুল ধারনা থাকার কারনে দেখা দেয় নানা রকম স্বাস্থ্য এবং অনেক সময় দেখা যায় দাম্পত্য জীবনেও কলহের সৃষ্টি হয় নানা রকম কুসংস্কারের কারনে।কিন্তু আমার জানামতে খুব কম বাবা-মা কিংবা পরিবারই আছেন মেয়ের পিরিয়ড নিয়ে উদারচিত্তের ব্যবহার।যেখানে শিক্ষিত সমাজেই রয়েছে এই পিরিয়ড নিয়ে নানা বিভ্রান্তি,সেখানে অল্পশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত লোকের কথা একবার ভাবুন তারা কত পিছিয়ে আছে সামাজিক প্রতিবন্ধিকতায়।পিরিয়ড মেয়েদের লোকানোর জিনিস না বরং গর্ভ করার বিষয় তার প্রথম ঋতুচক্রে।কারন এই পিরিয়ডের কারনেই সে মা হওয়ার অধিকার রাখে।

তবে হ্যাঁ,আমি বিশ্বাস করি যে, একটা সময় আসবে যখন আর কোন জড়তা থাকবে না মানুষের মনে পিরিয়ড নিয়ে।কিন্তু কবে,কোথায়,কখন পিরিয়ড নিয়ে জড়তা কাটবে তা শুধু অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকা সেই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে।তবে হয়তো জড়তা মুছে যাওয়া দিনকাল বেশীদিন নাই।কারন আজকাল শহুরে শিক্ষিত সমাজ এবং গ্রামেও বিভিন্ন গ্রামো কমিউনিটি হেলথ সেন্টার কিংবা ক্লিনিকে পিরিয়ড নিয়ে নানা রকম খোলামেলা কথা এবং নানা ধরনের কুসংস্কার দূরীকরনে কাজ করে যাচ্ছে সরকার এবং সমাজ সচেতন জ্ঞানী লোকেরা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন