শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক হাল

প্রতিটি গণতন্ত্রের মূলভিত্তি জনগণ। যেখানে জনগণের উপস্থিতি নেই, সেখানে কোনোদিন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে না। বিরোধী দল বা শাসক দলের আস্থা বৃদ্ধির একমাত্র হাতিয়ার জনগণ। জনগণের উপর আস্থা থাকলে বিরোধী দলের আন্দোলন কিংবা শাসক দলের শাসন সবসময় গণমুখী হয়। কিন্তু গণতন্ত্রে জনগণের ঘাটতি মানেই রাজনীতিতে মূল্যবোধের অবক্ষয়।দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে কোনো উন্নয়ন হবে না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধী দলকেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। দু’দলকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। তবে বিরোধী দল ছাড়া কখনই পার্লামেন্ট চলে না।“বিরোধী দল” শব্দটি একটি গণতান্ত্রিক শব্দ। আমাদের দেশের মত সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশে এই শব্দটির সাথে আমরা খুবই পরিচিত। একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের ভূমিকা আয়না স্বরূপ। সরকার যখন কোনক্ষেত্রে লাইনচ্যুত হয় বিরোধী দল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। দূরদর্শী সরকার হলে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক পথে চলার চেষ্টা করে এটাই বাস্তবতা এবং একটি আদর্শবাদী সরকারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।


সরকারের কোন অগণতান্ত্রিক, জনগণ ও দেশের জন্য অকল্যাণকর কাজ ও সিদ্ধান্তের সমালোচনা ও সরকারকে পরামর্শ দেয়াই ও সরকারকে সহযোগিতা করাই হল বিরোধী দলের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এর সংজ্ঞা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যে দলই সরকারে থাকুক না কেন তাদের অন্যতম এজেন্ডা হয়ে ওঠে বিরোধী দলকে দমন করা। তাদের সাংবিধানিক, রাজনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। জেল, যুলুম, অযৌক্তিক, রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলা দ্বারা প্রতিহত করা হয় তাদের যৌক্তিক আন্দোলনকে।


কোন দলের পক্ষে আজও সম্ভব হয়নি বিরোধী দলকে সাথে নিয়ে দেশের কাজ করা। আজীবনই আমাদের জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতার চেয়ারটি খালি থাকে। সরকার তাদের সংসদে যোগ দেবার নামমাত্র আহবান জানায়।আর সেই আহবানের সাড়া দিয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের দেশে সংসদের সেই আসনটি ভরাট হয়েছে কিনা তা আমার জানা নাই ঠিক।কিন্তু আবার সেই বিরোধী দলই আবার বলবে দেশে উন্নয়ন হচ্ছে না,বাজেট ঠিকমত হচ্ছে না,মানুষ নানা রকম দূর্ভোগে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি বলে দেশের মানুষকে পাগল করতে পাঁরে কিন্তু সে এটা জানে না যে,বিরোধী দল থেকে যেমন সমালোচনা করা যায় ঠিক তেমনই দেশের জন্য কাজ করে উন্নয়ন এবং পরবর্তী নির্বাচনে জনগণের কাছে প্রাধান্যও বৃদ্ধি করা যায়।অপরদিকে আমাদের দেশের বিরোধী দলের কোন পরামর্শও সরকার দল আমলে নেয়।আমাদের দেশে প্রধান দল হচ্ছে আওয়ামি-লীগ এবং বিএনপি।এই দুইটা দলের মাঝেই যেকোন একটা প্রধান বিরোধী দল থাকে।আর বাকী দল যেগুলা আছে সেগুলার কথা না বলাই ভালো।কারন সেগুলার কোমড় এবং হাটু দুইটাই ভাঙ্গা মেরুদণ্ড বিহীন দল।এদের সকালে এক কথা আবার বিকালে এক কথা।সেহেতু এদের কথা না বাড়িয়ে সরকার এবং বিরোধী দল নিয়েই বলা যাক।


আমরা যদি এই সঙ্কীর্ণতা থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারি তাহলে নিজেদের উন্নয়ন কখনও সম্ভব নয়। কারণ একটি গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম। বিরোধী দল যদি না থাকত তবে সরকারের কোনো ভুলই চোখে পড়ত না এবং কোন কাজ সমালোচনাহীনভাবে সুচারুরূপে শেষ হতো না।নয়তবা, সরকার জনগণ হতে প্রায় সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং একটি গণতান্ত্রিক দেশে জনগণ হতে বিচ্চিন্ন কোনো দলের পক্ষে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা আদৌ সম্ভব নয়।


কিন্তু আমাদের দেশের দুটি প্রধান দলের মধ্যে রাজনৈতিক ও মানসিক দূরত্ব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এই দূরত্ব ঘুচে যাওয়ার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই।তারা একদল আরেক দলের পিছনে সাপে নেওলের সম্পর্ক করে আছে।একদিকে বিরোধীদল সাধারন মানুষকে সাথে না নিয়ে বরং জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলে জ্বালাও পোড়াওয়ের নামে আন্দোলন করে অন্যদিকে সরকার দল বিরোধীদলকে দমানোর জন্য নেতা কর্মী গ্রেফতার এবং যৌক্তিক অযৌক্তিক মামলা দিয়ে জেলে পুড়ে রাখে।জনগণ আজ উভয় দলের ব্যবহারে ক্ষুব্দ।অথচ এটা তাদের স্মরণে থাকে না যে,দেশের জনগণ তাদের ভোট না দিলে ক্ষমতার মসনদেও বসার সুযোগ হতো না।

বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছে।দেশে আলোচিত খুন(ব্লগার,বিদেশী),নারী নির্যাতন,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং উৎখাত,স্বাধীনতার বিপক্ষ দল গুলোর অমানবিক তান্ডব,জঙ্গীবাদ,ধর্ষন,ক্ষমতাসীন দলের নেতা কর্মীদের উৎপাত চোখে পড়ার মত প্রতিদিন খবরের হেড লাইন(এমপি মন্ত্রী থেকে সাধারন মাঠ পর্যায়ের কর্মী),প্রশাসন দিনদিন ক্ষমতার জালে আটকে পড়ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।এই খারাপ অবস্থার জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। ফলে ক্রমজনিত খারাপ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। একটি স্বাধীন সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক দেশে এমন অবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।একদিকে বিরোধী দল যেমন যৌক্তিক সমালোচনা না করে ক্ষমতা লাভের জন্য বিভিন্ন অযৌক্তিক কথা বলে।যেমন,ঈদের পর সরকার পতনের জন্য আন্দোলনে নামবে,১০ম জাতীয় নির্বাচন কে প্রত্যাখান করে ক্ষমতা লাভের জন্য অপচেষ্টা,দেশের বাইরে কিংবা বিভিন্ন জাগায় সরকারের,দেশের,বিভিন্ন অন্যায়ের কথা উল্লেখ না করেই বলা দেশ অপরিস্থিশীল,৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবৈধ বলে নিজের ক্ষমতা লাভের জন্য সমালোচনা করা।কিন্তু কখনো এটা বলে না যে,দেশের মানুষ কি কি সমস্যায় ভুগছে,দেশকে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়,দেশের কোন কোন জাগায় এখনো ঠিকমত উন্নয়নের ছোয়া পাচ্ছে না,সরকারকে কোন সহযোগীতার আশ্বাস না দিয়ে শুধু ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বৈধ না বলেই দাবি করা বিরোধী দলের যেন প্রধান কাজ।সরকারের যদি সঠিকভাবে সমালোচনা করতে পারত বিরোধী দল,দেশের সরকারের যেমন উন্নয়ন করতে সুবিধা হতো,তেমনি বিভিন্ন ভুল ত্রুটি,অনিয়ম সরকারের চোখে পড়ত অন্যদিকে এসবের সমালোচনা করে জনগণের যেমন নজর কারা যেত বিরোধী দলের তেমনি বিরোধী দলের কোন যৌক্তিক আন্দোলনে মানুষের সমর্থন পেত।বিরোধীদলের উচিত বিভিন্ন সরকার দলীয়র অপকান্ড,দূর্নীতির পাশাপাশি উন্নয়নের দিক গুলা তুলে ধরে সাধারন মানুষের কাছে খোলাসা করা।


অবাক ব্যাপার যে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট এসব বিষয়ে আন্দোলন না করেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য দিশাহারা হয়ে পড়েছে। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভবিষ্যতে ক্ষমতায় যেতে হলে জনসমর্থন নিয়েই যেতে হবে। জনসমর্থন ছাড়া বাংলাদেশে পেশিশক্তির মাধ্যমে বা বন্দুকের নলের জোরে আর ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং বিরোধী দলের উচিত হবে, প্রথমে নিজের ঘর গোছানো এবং পরে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারের অগণতান্ত্রিক ও জনস্বার্থবিরোধী কর্মকান্ডের প্রতিবাদ করা।তারপর ক্ষমতা যাওয়ার স্বপ্ন দেখা উচিত বিরোধী দলের।তাছাড়া বিরোধী দল সরকার দলীয়র চাপে যেভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে এতে করে তাদের আর আগের অবস্থানে ফিরে আসা সম্ভব হবে না বলে আমি মনে করি। এ দেশের খেটে খাওয়া জনগণের মৌলিক চাহিদা যদি কোনো সরকার পূরণ করতে পারে তবে সে জনগণ কেন সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। কোনো সরকারের দ্বারা জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটলে, ওই সরকারকে কেউ ক্ষমতাচ্যুতও করতে পারে না। অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা দখল সে তো ভিন্ন বিষয়।


দেশের জনগণ যে সীমাহীন সমস্যা ও দুর্ভোগের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছে এ থেকে তাদের উদ্ধার করার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের, হোন তিনি সরকারি কিংবা বিরোধী দলের। যারা দেশ পরিচালনা করেন কিংবা দিকনির্দেশনা দেন, তাদের সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা এবং সুনজর ছাড়া দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে না। জনগণ কেবল পণ্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হবে এবং যানজটে পড়ে আটকে থাকবে।

বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও কর্মসংস্থান সঙ্কটে পড়বে। তাদের জীবনের নিরাপত্তা পদে পদে বিঘ্নিত হবে। অপরদিকে সরকার যদি জনগণকে দেয়া অঙ্গীকার ভুলে গিয়ে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখে দাবিদাওয়া উপেক্ষা করে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য বিরোধী দল নিহ্নিন করার চক্রান্তে মেতে থাকে এতে যেমন তাদের জন্য আত্মঘাতী তেমনি দেশ চলে যায় সংঘাতের মধ্যে।


রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেশপ্রেম থাকলে, জনগণের সমস্যা নিজেদের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে তা সমাধানে এগিয়ে এলে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন হওয়ার কথা নয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। যে দেশে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণের মহোৎসব চলে, যে দেশে সরকার ও বিরোধী দলের সঙ্গে কোনো সুসম্পর্ক নেই, জাতীয় সংসদ বছরের পর বছর অকার্যকর থাকে, আইনের শাসন নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়, শিল্পবিকাশ বিরোধী নীতির কারণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় না, সে দেশে জনস্বার্থ উপেক্ষিত থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিটি স্বাধীন দেশের মানুষ দেশের উন্নয়ন চাই । আজকের যুগে উন্নয়ন হলো রাজনীতির মূল হাতিয়ার । উন্নয়ন ছাড়া রাজনীতি অচল । উন্নয়ন চাই ,চাকরি চাই ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা চাই । রুজি রুটির বন্দোবস্ত চাই মানুষের।তাই সমাজের প্রতিটি মানুষের দাবি হলো উন্নয়ন । সুতরাং প্রতিটি সরকার ও দলের প্রধান লক্ষ্য হলো উন্নয়ন । উন্নয়ন ছাড়া সরকার ও দল চলতে পারেনা । আমাদের দেশে উন্নয়ন নিয়ে চলে নোংরা রাজনীতি । এই নোংরা রাজনীতির কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আশানারূপ দেশে শিল্পের উন্নয়ন আটকে যাচ্ছে । যা খুবই দুর্ভাগ্য আমাদের জন্য।


গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিতে বিরোধী দল থাকবে এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। রাজনীতিতে যদি পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই একটি দেশে শান্তি বিরাজ করবে না। আর শান্তি বিরাজ না করলে একটি দেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে সামনে অগ্রসর হতে পারবে না। দেশটি সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সমস্যার দিকে ধাবিত হতে থাকবে। বাংলাদেশে তাই পরিলক্ষিত হচ্ছে।


অপরদিকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ ক্যাডাররা দেশে ব্যাপকভাবে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুটপাট, টেন্ডারবাজি, হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, দখলদারি এবং ব্যাপক অরাজকতা চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিকে সরকার মোটেই দৃষ্টিপাত করছে না বরং আশ্রয়-প্রশ্রয় ও উস্কানি দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। একথা অনস্বীকার্য যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নত করতে হলে গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। আর গণতন্ত্রের ভীতকে মজবুত করতে হলে চাই গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ।


গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় বিরোধী দল বা দলসমূহের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে সংসদীয় বিরোধী দলের ভূমিকা অপরিসীম। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারি দলের ভূমিকা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলতে গেলে উভয়ের ভূমিকা প্রায় সমগুরুত্বসম্পন্ন। কারণ আজকে যিনি বিরোধী দলে আছেন কাল তাকে সরকারি দলে দেখা যেতে পারে। এটাই গণতন্ত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন