শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫

ধর্ম এবং নাস্তিক্যবাদ



আমরা সকলই বিভিন্ন কারণ-অকারণে ধর্ম এবং নাস্তিকতা নিয়ে একটু বেশী বাড়াবাড়ি করি।সেটা জেনে হোক,আর না জেনে হোক।তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আমরা সকলই না জেনে ধর্ম নিয়ে একটু বেশী কথা বলি কোন প্রসঙ্গ পেলে হয় শুধু।কিন্তু বেশীর ভাগ লোকই ধর্ম সম্পর্ক ভালোভাবে ধারণা না নিয়েই মনগড়া তথ্য নিয়ে শুরু করে দেয় তর্ক এবং নিজের মনগড়া তথ্যকেই সত্য বলে জাহির করার জন্য হানাহানি শুরু করে দেয়।শুরুতেই আমি বলে রাখতে চাই ধর্ম সম্পর্কে আমিও তেমন কিছু জানিনা।তবে আমি আমার ব্যাক্তিগত উপলব্ধি থেকে ধর্ম বলতে যা বুঝি, 'ধর্ম' হচ্ছে কোন কিছুর গুণ বা বৈশিষ্ট্য। জলের ধর্ম তারল্য, অগ্নির ধর্ম তাপ; তেমনিভাবে মানুষের ধর্ম হচ্ছে মনুষ্যত্ব। ধর্মকে একেকজন একেকভাবে সংজ্ঞায়িত করে এবং বিভাজন করে থাকে।আমাদের জন্মের সময় আমরা জানিনা আমাদের ধর্ম সম্পর্কে।কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা বড় হতে থাকি এবং একসময় জানতে পারি আমাকে এই ধর্মে বিশ্বাসী হয়ে বড় হতে হবে।সেই হিসেবে ধর্মকে আমরাই সৃষ্টি করেছি।ধর্ম নিয়ে কৌতুহলকে অনেকে নিন্দার চোখে দেখেন। তারা পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম বিশ্বাসে অবিচল আস্থা দেখানোর পক্ষপাতী। কিন্তু অনেকেই পাল্টা এই যুক্তি দেন যে, সবাই যদি বংশসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মে অবিচল থাকতো তবে পৃথিবীতে নতুন ধর্ম আসতো না।তাই ধর্মকে কিছু জাতিগত প্রথা ও সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ করাটা উচিৎ নয়। নিজের মনুষ্যত্ব বজায় রেখে, নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখা, ও একটি নৈতিক আদর্শ অনুসরণ করে স্বাভাবিক জীবন যাপন করাটাই প্রকৃত ধর্ম। ধর্ম মানবের, মানবিক ও সামাজিক চিন্তা, ব্যবহারও নৈতিকতার বিষয় নিয়ে কথা বলে । মুলত প্রাচীন কাল থেকেই ধর্ম মানুষের দৈনন্দিন আচার ও সংস্কৃতির ধারক হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে । যা প্রজন্ম পড় প্রজন্ম মানুষ জন্মগত ও সামাজিক ভাবে শিখে বড় হয়।

অপর দিকে বিভিন্ন দার্শনিকদের মতে ধর্ম সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যাখ্যা পোষন করেছে..............................

''ধর্ম এমন একটি ভাব, যাহা পশুকে মনুষ্যত্বে ও মানুষকে দেবত্বে উন্নীত করে।পরোপকার ই ধর্ম, পরপীড়ন ই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম। দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম,অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বরে এবং নিজ আত্মাতে বিশ্বাস ই ধর্ম, সন্দেহ ই পাপ। ''-- স্বামী বিবেকানন্দ

“বাঁচা বাড়ার মর্ম যা, ঠিকই জেনো ধর্ম তা।

বাচঁতে নরের যা যা লাগে, তাই নিয়েইতো ধর্ম জাগে।

অন্যে বাচায় নিজে থাকে, ধর্ম বলে জানিস তাকে।’’--শ্রীশ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র

"ধর্ম মানুষের চেয়ে উন্নত ধরণের একটি শক্তির বিধান, যে শক্তি মানব জীবন ও প্রকৃতির ধারাকে নিয়ন্ত্রণ ও বিশ্লেষণ করে।"--জেমস জি ফ্রেজার

১)আমি কে?

২)আমি কোথা হতে এসেছি?

৩)কোথায় যাচ্ছি?

৪)পৃথিবীতে আমার কাজ কী?


প্রশ্নগুলোর উত্তর এক এক মানুষের কাছে এক একভাবে ধরা দেয়। আর বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে ও বলা যায় যে, এ উত্তরের ভিন্নতার উপরই প্রাথমিকভাবে তৈরী হয়ে যায় ভিন্ন দু'টি পথ-ধর্ম আর নাস্তিকতা!

এতো গেলো জীবনাচরনের ওপর ভিত্তি করে ধর্ম আর নাস্তিকতার অবস্থান নির্ণয়। এবার, যদি ঐশ্বরিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখি, তাহলে বলা যায় যে, এক মহামহিম শক্তি বা স্বত্তা মানুষ সহ এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা- এই কথা মেনে নেওয়াই হলো ধর্মের মূল কথা আর এই কথার স্ববিরোধিতাকারীই নাস্তিক।

অর্থাৎ যেকোনো ধর্মের প্রধান এবং প্রথম উপাদান হল বিশ্বাস। মোট কথা হল ধর্ম হল স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস। অন্যভাবে বলা যায় ধর্ম হল স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক।পৃথিবীতে ধর্মের কি ভাবে শুরু কিংবা উৎপত্তি হয়েছিল তার ব্যাখ্যা ও ইতিহাস বিস্তর। তবে ৩ থেকে ৫ লক্ষ বছর আগে মধ্য প্রস্তরযুগে ধর্মীয় আচার আচরনের সাক্ষ্য প্রমান পাওয়া যায়।কিন্তু মানুষ যখন মাত্র ৫০০০ বছর আগে লিখার প্রচলন শুরু করে কেবল তখনই ধর্ম লিপিবদ্ধ করা সম্ভব হয়েছে।৫০০০ বছর পূর্বে ধর্ম সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন জাগায় তেমন কিছু বলা হয় নাই বলে জানি আমি যতদূর।আবার কালের আবর্তে অনেক ধর্মের উৎপত্তি,উস্থান,পতন এবং হারিয়েও গেছে।তবে ধর্মের অন্য একটি বিশেষ উপাদান হল আচার অনুষ্ঠান। প্রতিটা ধর্মেই নির্দিষ্ট আচার বিদ্যমান।যেমন মুসলমানরা বছরে ২ টা ঈদ উদযাপন করে,হিন্দুরা দুর্গাপূজা, কালীপূজা ইত্যাদি পালন করে। খ্রিস্টানরা বড়দিন উদযাপন করে ইত্যাদি ইত্যাদি।তাই সকল ধর্মেই কিছু পবিত্র বিষয় থাকে।যেকোনো ধর্মই ঐক্য সৃষ্টি করে। সকল ধর্ম পালনকারীদের ভিতর একটা গভীর ঐক্য থাকে। যদি কোন ধর্মের কেউ কোন ভাবে অন্য ধর্মের লোকের কাছে শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাহলে তাকে তার ধর্মের লোকজন একত্রিত হয়ে সাহায্য করে।ধর্মের মূল প্রাপ্তি সামাজিক মূল্যবোধ ।পাপ ও পুণ্যের বিচার । ভাল ও মন্দের ধারক । ধর্ম সেই আদিম কাল থেকেই মানবের মানবিক উৎকর্ষ বিকাশের প্রথম উপায় ।


এখনকার সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ব্যাপার মনে হয় “নাস্তিক"। ইংরেজি ‘এইথিজম’ (Atheism) শব্দের অর্থ হল নাস্তিকতা বা নিরীশ্বরবাদ। এইথিজম শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক ‘এথোস’ শব্দটি থেকে। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি দ্বারা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করে।

নাস্তিক কি? নাস্তিক্যবাদ কি আধুনিক কোন মতবাদ?

আমরা জানি নাস্তিক শব্দটির অর্থ হল, যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না। এটি খুবই সরল এবং স্পষ্ট।বৈদিক যুগ থেকেই কিছু মানুষ কল্পিত ঈশ্বরের উপর তাদের অনাস্থা জ্ঞাপন করে এসেছে।এই অনাস্থা প্রকাশের ভাষাই হচ্ছে নাস্তিক্যবাদ। নাস্তিকতা ও ধর্মহীনতা সম্পুরন আলাদা ।নাস্তিকতা একটি সম্পূর্ণ দার্শনিক মতবাদ , নাস্তিক হতে হলে কোন আচার করতে হয় না।

এক কথায়, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী একজন ব্যক্তিই নাস্তিক। যিনি যুক্তি-তর্ক-প্রমান-বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে শুধু বিশ্বাসের খাতিরেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না এবং যুক্তিবাদী চিন্তাশীল হিসেবে অবশ্যই ঈশ্বর এবং ধর্মের ধারনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। অনেকেই ধর্ম-বিশ্বাস এই বিষয়গুলোতে গভীরভাবে চিন্তা না করেই নাস্তিক হিসেবে নিজেকে জাহির করে ঠিকই কিন্তু বাস্তবে একজন নাস্তিকের শক্তি তার মুক্তচিন্তায়, সে ধর্ম এবং ঈশ্বর সম্পর্কে তার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর যুক্তি-প্রমানের ভিত্তিতে করতে আগ্রহী। তাই যৌক্তিক সমালোচনাবিহীন নাস্তিকতার কোন মূল্য নেই। পৃথিবীতে প্রায় ৪২০০ ধর্ম রয়েছে এবং সকল ধর্মেরই একটা বিশ্বাস যে,আমাদের সৃষ্টির পিছনে একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছে।প্রত্যেক ধর্মেরই একটা নিজস্ব আচার,ব্যবহার,অনুষ্ঠান,সংস্কৃতি এবং সৃষ্টিকর্তাকে বিভিন্ন নামে সম্ভোধন করে থাকে।কিন্তু আজ পর্যন্তই কোন ধর্ম অন্য ধর্মের আচার-আচরন,সংস্কৃতি এবং তার সৃষ্টিকর্তাকে স্বীকৃতি দেই নি।এক ধর্মের বিশ্বাসীর কাছে স্বাভাবিকভাবেই অপর ধর্মে বিশ্বাসীর "ঈশ্বর" কাল্পনিক এবং গুরুত্বহীন, আর নাস্তিকের কাছে তেমনই যেকোন ধর্মের ঈশ্বরই কাল্পনিক। রিচার্ড ডকিন্সের এসম্পর্কে উল্লেখযোগ্য একটি উক্তি হচ্ছে- “We are all atheists about most of the gods that humanity has ever believed in. Some of us just go one god further.”

মুলত অনেক কারনে মানুষ নাস্তিক হয়।একজন আস্তিকের নাস্তিক হওয়ার তেমনি কিছু কারন উল্লেখ করা হলো-

১) অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে।

২) প্রার্থনার উত্তর না পাওয়া।

৩) এক ধর্মের সাথে আরেক ধর্মের সাংঘর্ষিক কাড়নে।

৪)মানুষের মাঝে জাতভেদ থাকার কারনে।

৫)হাজারো ধর্মের উৎপত্তি এবং প্রত্যেক ধর্মের দাবি নিজ ধর্ম এবং নিজেদের বিশ্বাস ব্যতীত সকল ধর্ম মিথ্যা।

৬)সকল সৃষ্টির মূলে যদি একজনই হোন তাহলে এতো এতো ধর্ম কেন?

৭)ধর্ম গ্রন্থ গুলো নিজ ভাষায় পড়ার পর হাজারো অমানবিক দৃষ্টি ভঙ্গির কারনে।

৮) পারিবারিক ভাবে কঠিন ধর্মীয় বিধি নিষেধের মধ্যে বড় হওয়ার কারনে অনেকের মধ্যে ধর্ম এবং আল্লাহ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়।

৯) ধর্মীয় অনুশাসন পছন্দ না হওয়া নাস্তিক হবার পেছনে প্রভাব ফেলে।

১০)বিজ্ঞানের সাথে ইশ্বরের অস্তিত্ব না মিলাতে পেরে এবং বিভিন্ন নাস্তিক লেখকদের প্রশ্নবিদ্ধ বই পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি কারনে একজন মানুষ আস্তিক থেকে নাস্তিক হয়।

নাস্তিকতা শুধুই একটি ব্যাক্তিগত বিশ্বাস যা সে নিজের বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে । এতে কারো অধিকার নেই তার ব্যাক্তিগত বিশ্বাসকে অসন্মান করা । প্রতিটি মানুষের মত তারও অধিকার রয়েছে সন্মান পাবার । যদি কোন ধর্মীয় গুষ্টি সেটাকে সন্মান করতে না পারে তাহলে সেটা সেই ধর্মীয় গুষ্টির ব্যার্থতা । যুক্তি তর্ক অবশ্যই আসবে কিন্তু সেটার জন্য দরকার পারস্পারিক শ্রদ্ধা বোধ । সত্য সব সময় সত্যি বলেই প্রমানিত হয় । হোক সেটা হাজার বছর পরে।

যুক্তির জবাব সব সময় যুক্তির মাধ্যমে দিতে হয় কিন্তু তার জবাব তালোয়ারের মাধ্যমে দেয়া নেহাত বোকামী ছাড়া কিছু নয় । সত্য কে সত্যি বলে স্বিকার করতে দরকার শুধু নিজের বিবেক এবং বিচার বিশ্লেসন করার মত বুদ্ধিমত্বা । সিদ্ধান্ত প্রতিটি মানুষের নিজের উপর । আর মানুষের ব্যাক্তিগত স্বিদ্ধান্তের উপর অবশ্যই শ্রদ্ধা থাকা প্রয়োজন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন