শুক্রবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৫

হিন্দু/সনাতনী ধর্মের ঈশ্বর এবং মূর্তি পূজার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু হদিস



মূর্তি পূজার স্বরূপ জানতে হলে প্রথমে আমাদেরকে জানতে হবে ঈশ্বর ও দেবতা বলতে সনাতন দর্শনে কি বলা হয়েছে।ঈশ্বর ও দেবতা।প্রথমেই বলে রাখা দরকার সনাতন দর্শনে বহু ঈশ্বরবাদের স্থান নাই বরং সনাতনীরা একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী।সনাতন ধর্মাবলম্বি হিন্দুরা অনেক দেব দেবির পুজা করলেও সমাতন ধর্ম গ্রন্থ গুলোতে কেবল মাত্র এক জন ইশ্বরের উপাসনা করতে বলা হয়েছে॥


বেদের ‘ব্রহ্ম সুত্র’ তে আছে “একম ব্রহ্মা দ্বৈত্য নাস্তি নহিনা নাস্তি কিঞ্চন” অর্থাৎ ইশ্বর এক তাঁর মত কেউ নেই কেউ নেই সামান্যও নেই।আরও আছে “তিনি একজন তাঁরই উপাসনা কর” (ঋকবেদ ২;৪৫;১৬)। “একম এবম অদ্বৈত্তম” অর্থাৎ তিনি একজন তাঁর মত আর দ্বিতীয় কেউ নেই (ঋকবেদ ১;২;৩)। “এক জনেই বিশ্বের প্রভু” (ঋকবেদ ১০;১২১;৩)।


সনাতন দর্শন বলে, ঈশ্বর স্বয়ম্ভূ অর্থাৎ ঈশ্বর নিজে থেকে উৎপন্ন, তার কোন স্রষ্টা নাই, তিনি নিজেই নিজের স্রষ্টা।আমাদের প্রাচীন ঋষিগন বলে গিয়েছেন, ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট রূপ নেই(নিরাকার ব্রহ্ম) তাই তিনি অরূপ, তবে তিনি যে কোন রূপ ধারন করতে পারেন কারণ তিনি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।ঋকবেদে বলা আছে, ঈশ্বর ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’- ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।ঈশ্বর বা ব্রহ্ম (ব্রহ্মা নন) সম্পর্কে আরও বলা হয়,‘অবাংমনসগোচর’ অর্থাৎ ঈশ্বরকে কথা(বাক), মন বা চোখ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না,তিনি বাহ্য জগতের অতীত । ঈশ্বর সম্পর্কে ঋকবেদে বলা আছে-‘একং সদ বিপ্রা বহুধা বদন্তি (ঋক-১/৬৪/৪৬) অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে পণ্ডিতগণ বহু নামে বলে থাকেন।‘একং সন্তং বহুধন কল্পায়ন্তি’ (ঋক-১/১১৪/৫) অর্থাৎ সেই এক ঈশ্বরকে বহুরূপে কল্পনা করা হয়েছে।‘দেবানাং পূর্বে যুগে হসতঃ সদাজায়ত’ (ঋক-১০/৭২/৭) অর্থাৎ দেবতারও পূর্বে সেই অব্যাক্ত (ঈশ্বর) হতে ব্যক্ত জগত উৎপন্ন হয়েছে।ঈশ্বর এক কিন্তু দেবদেবী অনেক।তাহলে দেব দেবী কারা? ঈশ্বরকে বলা হয় নির্গুণ অর্থাৎ জগতের সব গুনের আধার তিনি। আবার ঈশ্বর সগুনও কারণ সর্ব শক্তিমান ।ঈশ্বর চাইলেই যে কোন গুনের অধিকারী হতে পারেন এবং সেই গুনের প্রকাশ তিনি ঘটাতে পারেন ।দেব দেবীগন ঈশ্বরের এই সগুনের প্রকাশ বলে সনাতনীদের দাবি।


হিন্দু ধর্মে মুর্তি পুজা সম্পর্কে কি বলা হয়েছে তা জেনে নেইঃ-
ভগবত গীতা – অধ্যায় ৭ – স্তব ২০ -
[যাদের বোধশক্তি পার্থিব আকাঙক্ষার মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে গেছে শুধু তারাই উপদেবতার নিকটে উপাসনা করে। ]
যজুর্বেদ – অধ্যায় ৪০- অনুচ্ছেদ ৯ –
[ অন্ধতম প্রভিশান্তি ইয়ে অশম্ভুতি মুপাস্তে – যারা অশম্ভুতির পুজা করে তারা অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তারা অধিকতর অন্ধকারে পতিত হয় শাম মুর্তির পুজা করে । অশম্ভুতি হল – প্রাকৃতিক বস্তু যেমন- বাতাস,পানি,আগুন । শাম মুর্তি হল – মানুষের তৈরী বস্তু যেমন - চেয়ার ,টেবিল ,মূর্তি ইত্যাদি।]
যেহেতু হিন্দু ধর্ম প্রাচীন ধর্ম, এবং সবার বেদ,গীতা পড়ার অধিকার ছিল না তাই সেই সময়কার কিছু ঋষি মুনির কারনে মুর্তি পুজোর উদ্ভব হয়েছে । ডা. চমনলাল গৌতম তাঁর বিষ্ণুরহস্য বই এর ১৪৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘ঋষিগন মুর্তি পুজার প্রচলন করেছেন॥ খ্রিষ্টীয় ৭ম শতাব্দী হতে বাংলায় কিছু কিছু অঞ্চলে কালী পূজা শুরু হয়॥১৭৬৮ সালে রচিত কাশীনাথের কালী সপর্যাসবিধি গ্রন্থে দীপান্বিতা অমাবস্যায় কালীপূজার বিধান পাওয়া যায়। [তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া]
"তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশকে বাংলায় কালীমূর্তি ও কালীপূজার প্রবর্তক মনে করা হয়।
( তথ্যসূত্রঃ হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ, তৃতীয় খণ্ড, হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য,কলকাতা, ২০০৭, পৃ.২৮৫-৮৭)।"


আবার,
যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চিতুমিচ্ছতি।তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামের বিদধাম্যহম।।
"অর্থ-পরমাত্মারুপে আমি সকলের হৃদয় বিরাজ করি। যখন কেউ দেবতাদের পূজা করতে ইচ্ছা করে আমি তাদের শ্রদ্ধানুসারে সেই সেই দেবতাদের প্রতি ভক্তি বিধান করি ।" [ভগবত গীতা – অধ্যায় ৭ – স্তব ২১]


স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে।লভতে চ ততঃ কামান্ময়ৈব বিহিতান হি তান।।
"অর্থ-সেই ভক্ত শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে সেই দেবতার আরাধনা করেন কিন্তু সেই দেবতার কাছ থেকে আমারই দ্বারা বিহিত কাম্য বস্তুলাভ করে।"[ভগবত গীতা – অধ্যায় ৭ – স্তব ২২]


মূর্তি পূজা সম্পর্কে উপরিউক্ত আলোচনা থেকে মূর্তি পূজার পক্ষে এবং বিপক্ষে দুইটাতে যাওয়া যায়।তবে ইদানিং দূর্গা পূজাকে সামনে রেখে মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং মূর্তি পূজার নিষেধ সম্পর্কে বয়ান দিয়ে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন ভাবে।বিশেষ করে ছদ্মবেশী উন্মাদরা এ প্ররোচনায় বেশী মেতে উঠেছে।তবে এটাও ঠিক যে,মূর্তি পূজা কখন কিভাবে চালু হয়েছে তার কোন নির্দিষ্ট হদিস নাই।সেই দিক দিয়ে মূর্তি পূজার বিপক্ষেই জোড়ালো কথা বলা গেলেও মূর্তি পূজা বিশ্বাসীদের কথা চিন্তা করে তাদের হদিস একবারে নিষেধাজ্ঞা হিসাবে গন্য করা যায় না।আপনি আস্তিক,নাস্তিক,স্যাকুলার যাই হোন না কেন;সামনে দূর্গা পূজাকে রেখে একপাক্ষিক যুক্তি দিয়ে কোন কিছু বলা মানেই মানুষের মনে সাম্প্রদায়িক সৃষ্টি করা ব্যতীত বা আপনি অন্য কোন উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যই এমন আচরন করছেন সেটা যে কেও সহজে বুঝতে পারবে।তবে এর মানে এই বুঝাতে চাইছিনা যে,আপনি হিন্দু ধর্মের সমালোচনা করতে পারবেন না।কিন্তু সমালোচনা করার আগে আপনাকে অবশ্যই সামাজিক এবং ভৌগলিক দুই অবস্থা ভেবেই কথা বলতে হবে।কারন আমদের দেশ যতই সাংবিধানিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলে দাবি করা হোক না কেন,প্রকৃত পক্ষে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপূর্ন একটা দেশ।


বি.দ্রঃআমি কোন জাত-ভেদ,ধর্মের দুনিয়া চাই না,আমি মানুষের দুনিয়া চাই।আমার বড় পরিচয় আমি মানুষ এবং আপনারাও মানুষ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন